Close

সৌদির চিঠি: আমার প্রমোশন, গুডবাই জেড্ডাহ; পর্ব- ৯

কর্পোরেট কেউ এমনি হয়? শ্রম শোষণের শত বছরের পদ্ধতিগত অভিজ্ঞতা যে সঞ্চয় করে, সেই শতগুণ মাইনে নিয়ে পদে বসে। অতএব আমাকেও জেড্ডাহ ছাড়তে হল।

কর্পোরেট কেউ এমনি হয়? শ্রম শোষণের শত বছরের পদ্ধতিগত অভিজ্ঞতা যে সঞ্চয় করে, সেই শতগুণ মাইনে নিয়ে পদে বসে। অতএব আমাকেও জেড্ডাহ ছাড়তে হল।

সৌদির চিঠি: কান্ড ঘটিয়ে বসলো শেফ,পর্ব-৮

আমার এই চাকরি ক্ষেত্রে এবং চাকরি জীবনে এক কঠিন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। আমার প্রোমোশন হতে চলেছে! অবশেষে। এই কোম্পানির সঙ্গে আমার এত দিনের কীর্তি শুনলে এই ঘটনাটি নিয়ে যেমন অবাক হতে হয়, তেমনি আবার সাথে সাথেই খুব স্বাভাবিকও মনে হবে। প্রথমে খুব অবিশ্বাস্য মনে হয়ে ঠিক পরের মূহুর্তেই মনে হবে যেন এটাই হওয়ার ছিল। কীভাবে, সেই নিয়েই আজ বলবো। হয়তো মনে হবে আজকের চিঠিতে আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করছি, কিন্তু এরমধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা এবং সত্য সামনে আসবে।


এই মূহুর্তে আমাদের ভারতীয় বাঙালি শ্রমিকদের বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটের সমস্ত ঝামেলা নিয়েই দুশ্চিন্তা। ভারতীয় এবং বাঙালি শ্রমিকরা সবসময়ই তাদের ঘরের খবর নিয়ে সচেতন থাকেন। তারা সবসময় সজাগ, এবং তাদের নিজস্ব এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থান নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তা আলোচনা করতেই থাকেন। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়েই এতমাস অনেক কান্ড হয়ে গেলো। সর্বদাই কোনো না কোনো লেবারের বিষয় নিয়ে ম্যানেজমেন্টের সাথে একটা দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। কখনো মাইনে নিয়ে না হলে কখনো ডিউটি নিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো মনে হবে যে শ্রমিকদেরই পরাজয় হয়েছে কিন্তু তাই বলে এই নয় যে তারা একবারও দমে গেছেন। আমি যখন প্রথমবার বাকিদের সাথে এইরকম এক ঘটনায় আওয়াজ তুলেছিলাম, ম্যানেজমেন্ট চমকে গেছিলো। আমার বড়ো শেফ আমাকে পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে জানালেন যে আমার কাছ থেকে তিনি এরকম আশা করেননি কারণ তিনি আমাকে “ওদের” পক্ষে হিসেবে মনে করতেন। ভেবেছিলেন আমি সবসময় ম্যানেজমেন্ট এবং মালিক পক্ষের অনুগত থাকবো, এবং চাইলেই উনি আমার ক্যারিয়ার বিশাল জায়গায় পৌঁছে দিতে পারেন। আমার মাথায় একটাই কথা খেলে গেল তখন, “এ ঘুষ দিতে এসছে!”


সেদিন আমি জানিয়েছিলাম যে আমি ওনার অথবা লেবারপক্ষ হিসেবে কিছুই দেখছিনা কারন আমি এখন নিজের পক্ষে। আমাদের সাথে যাই হচ্ছে, তার জন্য আমিও ভুক্তভোগী। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো, এটা আমাদের অনেকের মাইনে কাটার বিষয় নিয়ে ঝামেলা ছিল, যার জন্য আমরা অনেকে কাজ থামিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা আশ্চর্য জনক মনে হয়ে ছিল শেফের কাছে কারন বাকি শ্রমিকদের থেকে আলাদাভাবে আমি স্রেফ “কাজ” হিসেবে নয় বরং ক্যারিয়ার হিসেবে এখানে আছি। তাই উনি ভাবলেন এইসব বিষয়ে তো আমার নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে ম্যানেজমেন্টের পাশে দাঁড়ানোর কথা। আমি হঠাৎ বাকি লেবার এবং নিজের পক্ষ নিচ্ছি কেন! আমারতো আর মাইনে কাটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা নয় বরং কর্পোরেটের এইসব অসভ্যতামো মেনে নিয়ে নিজের কাজ এবং ক্যারিয়ারে মন দেওয়া উচিত!


সেই থেকে সবসময়ই যখনই লেবাররা কোনো কিছু নিয়ে ক্ষেপে উঠতো, তখনই আমি অজান্তেই সবার আগে হয়ে যেতাম। ম্যানেজমেন্ট এক দিক দিয়ে ধরেই নিয়েছিল যে লেবারদের যেকোনো ঝামেলা হলে আমি এক প্রকারের ইউনিয়ন লিডার। ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর শুনতে লাগলেও হাস্যকরও বটে। কিন্তু এরকম এক আবহাওয়া সৃষ্টি হওয়াতে আমার প্রতি কর্পোরেটের যে আরেক মনোভাব তৈরি হবে তার প্রমান পেতে বেশি সময় লাগেনি। প্রায়শঃই প্রোমোশনের টোপ দেওয়া, আমাকে রিয়াধ নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখানো, এই সব লেগেই থাকতো। জেড্ডাহ থেকে রিয়াধ নিয়ে গেলে বাকি শ্রমিকদের থেকে আমাকে আলাদা করা যাবে সেটাও আমার মনে হয়েছিল!


এখন অবশেষে সেই দিনটাই এসছে। আমার দুই বছরের চুক্তি ছিল এই কোম্পানিতে, অনেকবার কাজ ছেড়ে ভারত ফিরে যাবো এই হুমকির পর আজ এত দিনে চুক্তি শেষ হওয়ার ৪মাস আগে আমাকে রিয়াধ নিয়ে গিয়ে আমার দায়িত্ব বাড়ানোর কথা জানিয়ে গেলেন টপ বস। পুরো ম্যানেজমেন্ট যেন উৎসবের মেজাজে, আমাকে নতুন দায়িত্ব দিয়ে রিয়াধ নিয়ে গিয়ে কোম্পানির নতুন দোকান বাড়ানোর চিন্তায়! কোম্পানি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকছে, পুরো মিডল ইস্ট জুড়ে শাখা বাড়ানোর সম্ভাবনা, এই অবস্থায় আমার ভূমিকা ও তৈরি হয়ে গেল এতদিন পর, আমার দেশে ফেরার কিছুদিন আগেই। কর্পোরেট তো আর এমনিই হয়ে যায়নি, নিজের কোন লেবারকে কোন টোপ দিয়ে রাখতে হবে তা শিখেছে বলেই তো তারা একশো গুন বেশি মাইনে নিয়ে চেয়ারে হাওয়া খাওয়া কর্পোরেট!

সৌদির চিঠি: রূপকথার দেশের ইতিকথা জানালো সাবির(পর্ব ১০)

Leave a comment
scroll to top