সৌদির চিঠি, দূর্ঘটনার পর কি করে ঋন শোধ করবে জাভেদ!, পর্ব-৬
আজকের লেখাতে অনেকের হয়তো একটু অস্বস্তি হতে পারে, কারণ কিছু অদ্ভুত সত্য নিয়ে কথা বলতে চলেছি। সৌদি আরব,এবং সমগ্র মিডল ইস্টেই ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এত শ্রমিক আছেন, যে তাদের অনেক বিষয় নিয়ে আমাদের অনেকেই বিরক্ত, অথবা ক্ষোভ হতেই পারে। সেরকমই কিছু বিষয় নিয়ে আজ আলোচনা করতে চলেছি।
বাঙালিরা, অর্থাৎ বাংলাদেশীরা এখানে অনেক বছর থেকে যায়। প্রায় ৫ লক্ষ টাকা খরচ করে আসেন, এসে বছরের পর বছর সেই ধার শোধ করেন।এত টাকা ধার করেন যাতে এখানে আসতে পারেন, তারপর হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন সেই ধার শোধ করতে। অনেকটা আমার মতো ছেলেমেয়েদের এডুকেশন লোন নেওয়ার মত। শুনেছি সব পশ্চিমা “উন্নত” রাষ্ট্রগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা অনেক হাজার হাজার ডলার, অনেক ক্ষেত্রে লক্ষাধিক টাকা, নাকি ছাত্রঋণ হিসেবে নিতে বাধ্য হয়, তারপর ভার্সিটি পাস করার পর সেই ঋণ শোধ করতে চাকরি করতে বাধ্য হয়, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে একটা চাকরিতে পোষায় না তাই ২-৩ টি কাজ ধরতে হয় ঋণ পরিশোধ করতে এবং নিজের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্যে। চাকরির জন্য পড়াশোনা করতে ঋণ নিতে হবে, তারপর সেই ঋণ মেটাতে একগাদা চাকরি করতে হবে। একটা গোলক ধাঁধা যেন!
এখানেও তাই। বেশি টাকা কামানোর আশায় অনেক টাকা ধার নেয়, তার পর সৌদি-তে পৌঁছে সেই ধার শোধ করার জন্য রীতিমত হাস্যকর বেতনে কাজ করে এবং নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে গালি গালাজ করে। সেরকমই এক ব্যাক্তির সাথে পরিচয় হলো কিছুদিন আগে। এক বাঙালি ট্যাক্সি ড্রাইভার, নিজের নানা অভিজ্ঞতা এবং এখানে সবার পরিস্থিতি নিয়ে অনর্গল বলে গেলেন। ভদ্রলোক দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে এই দেশে আছেন। মাঝেমধ্যে ছুটি যাওয়া হয় দেশে নিজের পরিবারের কাছে, কিন্তু সেটা কখনোই যথেষ্ট হয়না ওনার সন্তানদের জন্য। গলায় একরাশ অভিমান নিয়ে বলতে থাকেন যে দুবছরে একবার ছুটিতে কি নিজের সন্তান নিজের বাবাকে চিনতে পারে! একটা বাচ্চা বড়ো হচ্ছে তার বাপকে না দেখেই, অথচ সেই বাপ আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে সেই পরিবারকে ধরে রাখার জন্য, হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে।
বাংলাদেশীদের এই ব্যাপারটা নিয়ে ভারতীয় বাঙালিরা, এমনকি তাদের মধ্যে মুসলমানরা ও ভীষণ বিদ্রুপ করে। একবার তো এমনই এক ব্যাক্তি এই নিয়ে বলেই ফেললেন যে এত এত বছর বাইরে থাকে, ঘরে ওদের বউটার কথা তো ভাববে, সেকি আর এত বছর এভাবে সংযম রেখে থাকতে চাইবে? প্রতিটি মানুষেরইতো একটু হলেও চাহিদা থাকে নিজের সবথেকে কাছের ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে সেই বা কেন অপেক্ষা করতে রাজি থাকবে?
তো যাইহোক, আমাদের সেই ট্যাক্সিচালকের কথায় আসা যাক। দেশে এখন এমনই মন্দা যে নিজের পরিবারকে অন্তত নিম্নরূপ সুবিধা সহ একটি জীবন দিতে হলে তার কাছে এইদুর দেশে শেখ দের গোলামী করা ছাড়া আর উপায় নেই। এবার সেটা করতে গিয়ে তার নিজের মেয়ে আর তাকে পেলো না বড়ো হওয়ার সময়ে। সেই রবি ঠাকুরের কাবুলিওয়ালার কথা মনে পড়ে গেল! আমাদের এই মানুষটিকেও যেন অনেকটা ওরকম দেখতে লাগছিলো ওনার ওই লম্বা দাড়ি নিয়ে! নিজের মেয়ের বেড়ে ওঠার প্রতি মুহূর্তগুলো উপভোগ করা, নাকি সেই মেয়েকে কোনো ভালো মাদ্রাসায় লেখাপড়া করিয়ে রোজ ভর পেট খেতে দেওয়া, এই দুটো চিন্তার মধ্যে কঠিন এক সিদ্ধান্ত ওনাকে নিতেই হতো।
ওনার সবথেকে বড়ো ক্ষোভ এবং দুশ্চিন্তা, অন্য এক কারণ নিয়ে। এক অন্ধকার জগত নিয়ে, যার খুব কাছেই আমরা বাসকরি। আমাদের থাকার জায়গা মানে যেখানে যাচ্ছিলাম, সেই জায়গার নাম শুনে বললেন জেদ্দাহ শহরে সব থেকে বেশি বেশ্যা বৃত্তি নাকি এই পাড়াতেই হয়! শুনে তো আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো, সৌদি আরবে এমন কাজ হতে পারেনা কি কখনো! উনি জানালেন, কোনও কিছুই আজকাল অসম্ভব নয় এখানে। আইনের ফাঁক ব্যবহার করতে দুশ্চরিত্র অসামাজিক মানুষের কমতি নেই। সরকার নাকি জেনেও অনেক সময়ে কিছু করেনা, কারণ একটাই উদ্দেশ্য, যেটা শুনলে চমকে উঠবেন কেউই – “লেবাররা যেটুকু রোজগার করছে, সেটা দেশে না পাঠিয়ে এখানেই খরচা করুক! বেশ্যাদের দিলেও তো এক দিক দিয়ে সৌদি দালালদের পকেট ভরবে”… হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় এসব বাস্তবের সম্মুখীন হলে। ওনার দাবি উনি নাকি সিলেটের কোনো মহিলাকে জানেন, যিনি নাকি এই কাজে যুক্ত এই পাড়াতেই, এবং এই কাজের দৌলতে নাকি মাত্র কয়েক বছরে দেশে নিজের গ্রামে দুটো বাড়ি খাড়া করে ফেলেছেন। সপ্তাহে আয় ৫ হাজার রিয়ালের কাছাকাছি, যা ভারতীয় মুদ্রায় আজ লক্ষাধিক!
এমনিতেই শ্রমিকরা বেতন হিসেবে এখানকার অর্থনীতি এবং বাজার অনুযায়ী নামমাত্র একটা অঙ্ক পান, আবার তারমধ্যেই এই ধরনের নোংরা ফাঁদ পাতা থাকে সর্বত্র। এই পরিস্থিতিতে যে সেই অসহায়, নিরুপায় প্রবাসী মহিলাদের কি দুরবস্থা, তারা যে কি সাংঘাতিক খিদে মেটানোর দায়ে এই চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছেন, সেটা বোধ গম্য হওয়ার মতো ধৈর্য আর ক্ষমতা আমাদের সেই পরিশ্রান্ত, আশা হারানো ট্যাক্সি চাচার হয়তো আর ছিলনা।