সৌদির চিঠি: “পাওনা টাকা তুই রাখ” পালিয়ে গেল দুজনে, পর্ব ২
এখানে আসার পর থেকেই দেখছি, শ্রমিকরা সারাক্ষণ তাদের ফোনে মশগুল থাকতে পছন্দ করেন, এমনকি একসাথে ৪-৫জন বসে থাকলেও। তাদের সারাদিনের জ্বালা ভুলে থাকার জন্য। ভাবতাম বিদেশে থাকা শ্রমিকদের হাতে স্মার্ট ফোন ধরিয়ে সস্তায় নেট দিয়ে আফিমের মতো তাদের সেই নেশায় ডুবিয়ে রাখা হয় যাতে তারা তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ না পায়, এখন দেখছি সেটা করতে গিয়েই হিতে বিপরীত হয়েছে। যেখানে সারাদিনের খাটনির পর একটু মনোরঞ্জনের জন্য আসা, সেখানেই তো সমস্ত দুনিয়ার চাবিকাঠি। এতজন নিরক্ষর শ্রমিক তো খবরের কাগজ পড়তে জানবেন না, কিন্তু অনলাইন নেশার ভান্ডার সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ভাষায় তাদেরই দেশের লক্ষ লক্ষ খবরের প্রচার তো থামবে না!
গত সপ্তাহে জুম্মায় এক অভাবনীয় কান্ড ঘটে গেল। জুম্মা বার, অর্থাৎ শুক্রবারের নামাজ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মুসলমানদের কাছে তা না বলাই বাহুল্য। আমার রেস্টুরেন্টে আমি আর ওয়েটার রা ছাড়া সকলেই মুসলিম। নতুন কর্মীরা স্বাভাবিক ভাবেই নামাজের সময়ে মসজিদ যাওয়ার জন্য আধ ঘন্টার বিরতি চেয়েছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে আরেক শেফ(সে নিজেও মুসলিম) এবং হেড ওয়েটার জানিয়ে দিল যে ডাইন ইন বন্ধ থাকলেও নামাজের সময়ে ডেলিভারি অর্ডার বন্ধ হবে না। সুতরাং কাজ ছেড়ে ওদের মসজিদে যাওয়া উচিত হবে না। আমি একবার চেষ্টা করলাম এই নিয়ে ঝামেলা করতে, যে সৌদি আরবের কানুন অনুযায়ী নামাজের সময়ে সব বন্ধ রাখা উচিত, কিন্তু বড় শেখ নিজে এসে আমাকে চূড়ান্ত বকাবকি করে গেল। এই শেফ আর এক্সিকিউটিভ ম্যানেজাররা সবাই খ্রিষ্টান, আর ওই হেড ওয়েটার মোনা পাঞ্জাবি। আমি নিজে এক হিন্দু পরিবার থেকে কিন্তু মুসলিমদের কাছে জুম্মার গুরুত্ব বুঝি। শেফ আর ম্যানেজাররা সাফ জানিয়ে দিল, যে নামাজ থাকুক আর যাই হোক, বিজনেস থামবে না। নতুন ছেলেটা শেষে মাথা নামিয়ে সরে এসে আপন মনেই বললো শুনলাম, “আললাহ মাফ কারে…”। হায় রে মুর্খ, এখনও বুঝলো না, সৌদি হোক কি ভ্যাটিকান হোক, করপোরেট হুকুম করলে ঈশ্বরও মাফ করতে বাধ্য!
এই সপ্তাহে আরো একবার গত সপ্তাহের অনিমেষের মত একটা ঘটনা ঘটে গেল। সিনিয়র শেফ হঠাৎ আরেকটি ছেলেকে ছাঁটাই করলেন, “কাজ পারে না” এই অভিযোগে। ছেলেটি আমার মতোই উত্তর কলকাতার বাসিন্দা। আমরা এরপর রুমে ফিরে সবাই এই নিয়ে আলোচনায় বসলাম। এভাবে তো কাজ করা দূর, বিদেশে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে উঠবে। যাকে যখন ইচ্ছা যেকোনো ভুলভাল কারন দেখিয়ে বার করে দেওয়া যায় নাকি! বিদেশে নিয়ে এসে এজেন্সিদের হাতে তো হেনস্থা হতে হয়ই, এখন চাকরিদাতাও এরকম শুরু করলে তো সত্যিই মুশকিল। সবাই মিলে এর কারণ খুঁজে বার করার চেষ্টা করতে সকলের মনে হলো, যে কোম্পানি এইসব অসভ্যতামো করছে নিজের গাঁটের কথা ভেবে। স্বাভাবিক। কিন্তু এটা কিরকম খেলা আসলে? যা মনে হলো সবার, এইভাবে কিছুদিন পর পর যদি কর্মী বদলাতে থাকে, তাহলে কোম্পানির ম্যানেজার ওদের নামে কোম্পানি থেকে মাইনের টাকা তোলা যাবে যেটা দালালের সাথে ভাগাভাগি হবে কর্মী নিয়োগের নামে, আর যার মধ্যে থেকে সেই কর্মী কে কতটা দেওয়া হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ। কারণ তাকে তো কাজ না জানার জন্য ছাঁটাই করা হয়েছে! ব্যাপারটা ভীষণ অলীক কল্পনা মনে হলেও আর কোনো ব্যাখ্যা কেউ খুঁজে পেল না এইভাবে শুধু ফায়ার করার জন্য হায়ার করার পদ্ধতির ক্ষেত্রে। যারা আসলে কাজ জানে না, তাদের হায়ার করছে যাতে কিছুদিন কাজ করিয়ে নিয়ে ফায়ার করে দেওয়া যায়। এ হেন নির্মম হেনস্থার আর কিই বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব, কারন কর্পোরেট তো আর যাই করুক, শুধুমাত্র পৈশাচিক আনন্দের কথা ভেবে কিছু করে না – তারা শুধুমাত্র নিজেদের মুনাফাটাই দেখবে, এটাই তো জানা কথা।
সৌদির চিঠি; পালানোর বোকামিটা করেই ফেললো আসানসোলের ছেলেটা, পর্ব-৪