রুশ বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা আক্রমণ শানিয়েছেন এই বলে যে, ভ্লাদিমির জেলেনস্কির শাসনে ইউক্রেন এতোটাই অন্ধ কমিউনিজম বিরোধী হয়ে উঠেছে যে তারা মে দিবস অর্থাৎ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ছুটিটাই তুলে দিয়েছে, ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে।
১৯২২ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের সময় কিংবা ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আগেও বিশ্ব জুড়ে শ্রমিক দিবস পালিত হত, জাখারোভা ব্যাখ্যা করছিলেন, ইউক্রেন, সোভিয়েত-বিরোধী উন্মত্ততার ছদ্মবেশে, শ্রমিক স্বার্থে আঘাত দিয়েছে, শ্রমিকের মর্যাদাকে বেআব্রু করেছে।
তিনি জানান, ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত ১৮৮৯ সালের জুলাই মাসে প্রথম আন্তর্জাতিকের একটি সভায় গৃহীত হয়েছিল। একই তারিখে শিকাগো, ইলিনয়ের হে মার্কেটে মার্কিন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিহত শ্রমিকদের স্মরণে শ্রমিক দিবসের ধারণার উদ্ভব হয়।
ইউক্রেনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদযাপন বাতিল করার সিদ্ধান্তকে একটি হাস্যকর সিদ্ধান্ত ব’লে অভিহিত করেন জাখারোভা। জেলেনস্কির শাসনকে ব্যাঙ্গ করে তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দেশ, যাদেরকে প্রাক্তন ভাঁড়ের সরকার (এক্ষেত্রে ইউক্রেন, জেলেনস্কি প্রাক্তন কৌতুক অভিনেতা) মিত্র ব’লে মনে করে, তারাও এই অনুষ্ঠান উদযাপন করে।
সাংবাদিক সম্মেলনে, জাখারোভা ইউক্রেনের সরকারকে ইতিহাস পুনর্লিখনের স্বেচ্ছাচারের অভিযোগ আনেন, বলেন যে এতে ওদের আসল রঙ সামনে আসবে। ইউক্রেনে নাৎসি জার্মানির প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগে পশ্চিমাদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য পশ্চিমাদের একহাত নেন। দনবাস অঞ্চলে কিয়েভের অনুগত বাহিনী যে শিশুহত্যা করেছে তাতে পশ্চিমের চুপ থাকা তাদের ‘ভন্ডামি’-র পরিচয়।
জাখারোভা উদ্ধৃত করেছেন কীভাবে ইউক্রেনের কুখ্যাত ‘ময়দান বিপ্লব’-এর পরে, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে পতনের পরপর, নব্য-নাৎসি বাহিনী ওডেসাতে ট্রেড ইউনিয়ন ভবনে হামলা চালায়। পশ্চিমা বিরোধী বামপন্থী কর্মীদের ওপর গণহত্যা চালায়। যেখান থেকে দনবাস অঞ্চলে সমস্যার সূত্রপাত হয়। দনবাসে রুশ-ভাষী সংখ্যালঘুরা কিয়েভ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।
তিনি আরও সমালোচনা করেন যে, নাৎসি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ ইউক্রেনীয় শাসন কীভাবে রুশ সাহিত্য বয়কট করেছে। পুশকিন, টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি প্রমুখের মতো রুশ সাহিত্যিকদের নিষিদ্ধ করেছে। তিনি এটিকে জার্মানিতে নাৎসিদের প্রগতিশীল বই পোড়ানোর সাথে তুলনা করেন।
ইউক্রেন সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের সমালোচনা করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন, শ্রমিকের অধিকারের মতো বিষয়গুলিতে, এবং দনবাসে নারী ও শিশু হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে তাদের কোন অস্বস্তি নেই।
জাখারোভা মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো (NATO) সামরিক জোটকে ফিনল্যান্ডের জমি ব্যবহার করে রাশিয়ার ওপর কোনোরূপ হামলার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। “আমরা NATO-র ফিনল্যান্ড সম্পর্কিত পরিকল্পনা সম্পর্কে নজর রাখছি। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার মর্মে যে কোন সংকট রুখতে রাশিয়া সামরিক ও প্রযুক্তিগত এবং অন্যান্য ধরনের ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে,” তিনি বলেন।
তিনি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের জন্য ফরাসি সরকারের সমালোচনা করেন। পেনশন সংস্কারের দাবিতে প্রতিবাদকারী শ্রমিক শ্রেণীর উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানো হয়েছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইন বিস্ফোরণে ইউরোপীয় দেশগুলির তদন্তকে বলেছেন সারশুন্য, এই তদন্তে রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার পশ্চিমে শাসন পরিবর্তনের পরিকল্পনার জন্য দায়ী কিনা সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাখারোভা বলেন যে মস্কো কখনোই “রঙিন বিপ্লবে” লিপ্ত হয়নি এবং কোনো দেশে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে কোনো ভূমিকা পালন করেনি।
বরং, তিনি অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যান্য দেশে নির্বাচিত সরকারগুলির পতনে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করেছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে এটা ওদের স্বভাব, সংকট আড়াল করার জন্য কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীদের দোষারোপ করার জন্য মস্কোকে ব্যবহার করা।
সম্প্রতি ওয়ারশতে রুশ দূতাবাসের স্কুল দখলের জন্য রাশিয়া কীভাবে পোলিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে এবং এখনই বলার সময় আসেনি। জাখারোভা বলেন যে রাশিয়া কেবল ফাঁপা কথাবার্তা বলে না, যা বলে সেভাবেই চলে।
জেলেনস্কির সাথে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের টেলিফোনিক আলোচনাকে, যেখানে শি দলগুলোর মধ্যে শান্তির ওপর জোর দিয়েছিলেন, রাশিয়া কীভাবে দেখছে সে সম্পর্কে CGTN-এর একজন চীনা সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে, জাখারোভা বলেন মস্কো তার আগের বক্তব্যে অটুট আছে, এবং ইউক্রেনকে একেবারেই বিশ্বাস করা যায় না।
জাখারোভা পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে ইউক্রেনের সরকার চরিত্রগতভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী। তিনি একটি মুহূর্ত উদ্ধৃত করেছিলেন যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে (UNSC) মার্কিন প্রতিনিধিদের একজন চীনা দূতের সামনে বলেছিলেন যে কীভাবে ‘সাম্যবাদবিরোধী’ অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক বৈদেশিক নীতির স্তম্ভগুলির একটি। জাখারোভা এই ধরনের ‘কমিউনিস্ট-বিরোধী’ অবস্থানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে (CPC) বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন।
জাখারোভা প্রেসকে আরও জানান যে কীভাবে রুশ সরকার সুদান থেকে শুধু তার নাগরিকদেরই নয় বরং অন্যান্য দেশের নাগরিক দের উদ্ধার করেছে, এবং মস্কোর বিশেষ সামরিক অভিযানের অনেক আগে, ২০২০ তে কোভিড-১৯ এর উদ্ধারকার্যের সময় ইউক্রেনের পক্ষপাতিত্বের সমালোচনা করেন।
তিনি জানান যে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (SCO) বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দিতে ৪ঠা ও ৫ম মে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি সফর করবেন। জাখারোভা আরও জানিয়েছেন যে রাষ্ট্রপতি পুতিন এই বছরের শেষের দিকে SCO রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকে যোগ দিতে নয়াদিল্লি সফর করবেন।