কলকাতা পৌরসভায় বাজেট অধিবেশন চলার মাঝেই, সোমবার, ২০শে মার্চ তখন পৌরসভা ভবনের বাইরে নিজাম হোটেলের সামনে বিক্ষোভ জমায়েতে সামিল হলেন হাজার খানেক অস্থায়ী শ্রমিক কর্মচারী। বিক্ষোভ ঠেকাতে কলকাতা পৌরসভার বাইরে পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকলেও পুলিশের সাথে এদিন কোনো সংঘাত হয়নি। স্থায়ীকরণ, মজুরি বৃদ্ধি সহ একাধিক দাবিতে জমায়েত করেন পৌরসভার শ্রমিক কর্মচারীরা।
কলকাতা কন্ট্রাক্টর ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খোকন মজুমদার বলেন, পৌরসভায় মাত্র দশ থেকে ১২ হাজার স্থায়ী কর্মী। একশো দিনের কাজের কর্মচারীদের ধরে ৩০ হাজারের উপরে চুক্তি-ভিত্তিক অস্থায়ী শ্রমিক পৌরসভায় কাজ করেন। কিছু কিছু জায়গায় ন্যুনতম মজুরিও তারা পান, কিছু কিছু জায়গায় পাননা। এদের অনেকেই নর্দমা সাফ করেন, কিন্তু এদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই শ্রমিকেরা নিয়মিত বেতনও পাননা। এরা বেতন দিতে দেরি করে কন্ট্রাক্টর গাফিলতি করে। স্বাস্থ্য, ড্রেনেজ, জল সরবরাহ সব জায়গায় একই অবস্থা।
ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া থেকে কলকাতা পৌরসভার যে স্বাস্থ্য কর্মীরা নাগরিকদের সুরক্ষা দেন তাদেরই কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা নেই, এমন অভিযোগ উঠেছে। বছর চল্লিশের অমর ঘোষাল কলকাতা কর্পোরেশনের বোরো ১, ৪ নং ওয়ার্ডের স্বাস্থ্য দফতরে কাজ করেন। ঘোষাল বলেন, “দীর্ঘ ১৩/১৪ বছর হয়ে গেল কাজ করছি। আমাদের কাজ ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার বিষয়গুলোয় নজর রাখা। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সার্ভে করতে হয়, লার্ভা মারতে হয়। আমাদের ছুটি বলে সেরকম কিছু নেই। আমাদের নিজস্ব কোনো সিকিউরিটি নেই। ইএসআই, গ্রাচুইটি, মজুরি বৃদ্ধি কিছু হয় না আমাদের। তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি, কারণ এগুলো মানুষের সাথে সম্পর্কিত কাজ। তাই মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাই। দীর্ঘ দিন কাজ করতে করতে আমরাও তো হাপিয়ে যাচ্ছি। আমাদেরও তো পেট, সংসার আছে।” ঘোষাল আরো বলেন, “বামফ্রন্টের আমলে দেখেছিলাম ১০ বছর কাজ করার পর পার্মানেন্ট করে নেওয়া হত, এখন পার্মানেন্টের কোনো ব্যাপার নেই।”
তারক ওঝা (৪২), কলকাতা পৌরসভার ড্রাইভার। ওঝা বলেন, আমরা স্থায়ী হতে চাই, কর্পোরেশন থেকে ডাইরেক্ট মাইনে পেতে চাই। আমাদের দিচ্ছে না। আমাদের মাইনে মাঝখানে কন্ট্রাক্টর খেয়ে যাচ্ছে। এখন দশ হাজার টাকা মাইনেতে কী হবে?”
বাঁশদ্রোণী বাজারে সিকিউরিটির কাজ করেন কালিদাস চক্রবর্তী (৪৯)। চক্রবর্তী বলেন, “২০-২২ বছর ধরে কাজ করছি, আমাদের বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে না। পিএফ এর টাকা ঠিক মত জমা পড়ে না। মাইনে সময়মত হয় না।”
বিক্ষোভ চলাকালীন পৌরসভা থেকে নেমে এসে শ্রমিকদের জমায়েতে যোগদান করেন কলকাতা পৌরসভার দুই বাম কাউন্সিলর – ১০৩ নং ওয়ার্ডের নন্দিতা রায় এবং ৯২ নং ওয়ার্ডের মধুছন্দা দেব। দেব পৌরসভার একাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান। রায় বলেন, “ভেতরে আমরা দুজন হলেও, আমরা জানি বাইরে আপনারা (শ্রমিক-কর্মচারীরা) সবাই আছেন। অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। দেব বলেন, ১০০ দিনের কাজ যারা করছেন, তাদেরকেও অস্থায়ী কর্মী হিসেবে ধরছি আমরা, শূন্য পদ পূরণে আগে অস্থায়ীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আপনাদের পাশে আমরা আছি।”
শুধু স্থায়ী কাজ বা বেতন বৃদ্ধি নয়, তিন মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে জমায়েতে যোগদান করেছিলেন মিলেনিয়াম পার্কের কর্মচারীরা। মিলেনিয়াম পার্কের কর্মী প্রবীর সাহা(৪৯) বলেন, “কেএমডিএ থেকে কলকাতা পৌরসভার হাতে পার্ক হস্তান্তরিত হওয়ার পর থেকে পার্ক পরিচালনার জন্য কোনো কন্ট্রাক্টর লিপিবদ্ধ হয়নি। আমরা কার অধীনে কাজ করছি বুঝতে পারছি না। তিন মাস ৪৪ জন কর্মচারীর কোনো মাইনে হয়নি।”
১৯শে মার্চ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে কলকাতা পৌরসভার মুখ্য আইন অধিকারিক চা কফি বাবদ ৩৫ হাজার টাকা ভাতা পান। আগের বছর পেতেন ৩০ হাজার টাকা। এ বছর ৬ই জানুয়ারি আরো পাঁচ হাজার টাকা ভাতা বাড়ানো হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধির দাবির নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই প্রসঙ্গ টেনে সিআইটিইউর জেলা সেক্রেটারিয়েট সদস্য সৌম্যদীপ রজক বলেন, কলকাতা পৌরসভার অফিসার ৩৫ হাজার টাকা চা এর জন্য পান। কলকাতার ঘুম ভাঙার আগে যারা গোটা শহরকে পরিস্কার রাখেন এটা তাদের চার মাসের মাইনে!
অস্থায়ী কর্মচারীদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন কিছু স্থায়ী কর্মচারীও। কলকাতা কর্পোরেশনের এসেসমেন্ট সাউথের স্থায়ী কর্মচারী প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, “পৌরসভার দিন দিন স্থায়ী কর্মচারীদের সংখ্যা কমিয়ে সেখানে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করছে। ইসআইবেতন বৃদ্ধি গ্রাচুইটি নিয়ে অস্থায়ী কর্মীদের দাবি ন্যায্য এবং গণতান্ত্রিক, যা স্থায়ী কর্মীদের দাবি গুলোর সাথে সম্পৃক্ত এবং সমসাময়িক তাই আমরা স্থায়ীরা (কর্মচারীরা) এই জমায়েতে এসেছি।”
শ্রমিকদের দাবি দাওয়া ও নিয়মিতকরণ করার বিষয়ে মেয়র ফিরহাদ হাকিম এবং ডেপুটি মেয়র অতিন ঘোষকে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কোনো উত্তর দেননি। পুরসভার তরফ থেকেও কোনো জবাব দেওয়া হয়নি।