প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (পিটিআই) একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০২২ সালে রেকর্ড মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা সরকারের প্রকাশ করা তথ্য উল্লেখ করে পিটিআই জানিয়েছে যে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৮.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ১২,৫০০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১৩,৫৯৮ কোটি মার্কিন ডলার হয়েছে। যদিও ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই দুই দেশের মধ্যে নানা টানাপোড়েন বর্তমান।
ভারত ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শীতলতা বৃদ্ধি পায় ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষের পর থেকে। ভারত চীনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা মার্কিন-নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট কোয়াড-র একটি সদস্য দেশ। এ ছাড়াও বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে ভারত ও চীনের দ্বন্দ্ব বারবার প্রকাশ হয়েছে সাম্প্রতিক বিশ্বে। এহেন পরিস্থিতিতে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি একটি আশার আলো দেখাচ্ছে, যার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক কে উন্নত করা সম্ভব।
যদিও ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু এর ফলে কিন্তু ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির সমস্যা শেষ হয়নি। বরং ২০২২ সালে প্রথমবার ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারতের ঘাটতির পরিমাণ ১০,০০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে ২০২১ সালে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারতের পক্ষে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৬,৯৩৮ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে সেটা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১০,১০২ কোটি মার্কিন ডলার।
চীনের সার্বিক বাণিজ্য বৃদ্ধি
প্রায় দুই বছর ধরে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে চীনের অর্থনীতি ধাক্কা খেলেও ও লকডাউন এবং “শূন্য কোভিড” নীতিি নামক করোনা নিয়ে নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা চীনে নভেম্বর ২০২২ অবধি বজায় থাকলেও, ২০২২ সালে চীনের সার্বিক বিদেশী বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা কাস্টমস এর তথ্য ব্যবহার করে চীনা সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস এই খবর জানিয়েছে।
২০২২ সালে চীনা বিদেশী বাণিজ্য প্রথমবার বৃদ্ধি পেয়ে ৫.৯৬ লক্ষ ডলারে পৌঁছেছে। এর সাথে সাথে, চীনের পণ্য রফতানি ২০২১ সালের তুলনায় ১০.৫% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৩%, যার ফলে বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ৫.৩ লক্ষ ইউয়ান থেকে বেড়ে ৫.৯ লক্ষ ইউয়ান হয়েছে।
চীনের সোলার সেল, লিথিয়াম ব্যাটারি ও গাড়ির রফতানি সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়, যথাক্রমে ৬৭.৮%, ৮৬.৭%, ও ৮২.২%। এর সাথেই শ্রম নিবিড় পণ্যগুলির, যেমন ব্যাগ, জুতা ও খেলনার, রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৩২.৬%, ২৪.৪% ও ৯.১%।
গ্লোবাল টাইমসের রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালে চীন প্রধানত আমদানি করেছে জ্বালানি, যেমন কাঁচা তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা, যা তার মোট আমদানির ১৭.৬%। কৃষিজাত পণ্য আমদানি করা হয়েছে ১.৫৭ লক্ষ কোটি ইউয়ান মূল্যের, যা ২০২১ সালের তুলনায় ১০.৮% বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিদেশী বাণিজ্য বাড়ার ফলে চীনে বৈদেশিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের তুলনায় ৫.৬% বৃদ্ধি পেয়ে চীনে মোট ৫৯৮,০০০ বৈদেশিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে কার্যরত, যাদের মধ্যে ৫ লক্ষই হল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২০২২ সালে দাঁড়ায় ২১.৪ লক্ষ ইউয়ানে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ১২.৯% বার্ষিক বৃদ্ধি।
চীনের বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতি
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান কে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন যে কূটনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয় তার ফল ভুগতে হয় চীনকেও। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমী জোটে চীন বা ভারতের মতন বৃহৎ শক্তিগুলো যোগ না দেওয়ায় মার্কিন-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী শিবিরের রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভাবে পঙ্গু করার পরিকল্পনা এক প্রকার ভেস্তেই গেছে।
এর মধ্যে তাইওয়ান কে কেন্দ্র করে ২০২২ সালের অগাস্ট মাসে মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে। মার্কিন সংসদ হাউজ অফ রিপ্রেসেন্টেটিভস এর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান ভ্রমণ ও মার্কিন সরকারের “এক চীন” নীতি উল্লঙ্ঘন করা কে কেন্দ্র করে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয় ও সামরিক পেশী শক্তি প্রদর্শনও হয়।
চীনের “শূন্য কোভিড” নীতি প্রত্যাহার করার আগে ও পরেও চীনা সরকার ও শাসক কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় পশ্চিমী দেশগুলোয়। বিশেষ করে মার্কিন মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত সিপিসি ও চীনের সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়। তবুও মার্কিন-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০২২ সালে ৫.০৫ লক্ষ কোটি ইউয়ানে পৌঁছায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর সাথে চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫.৬৫ লক্ষ কোটি ইউয়ান হয়েছে।
রাশিয়ার সাথে চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বার্ষিক হিসাবে ৩৪.৩% বৃদ্ধি পেয়েছে ২০২২ সালে, ও ১.২৮ লক্ষ ইউয়ানে পৌঁছেছে, যা শুধু অভূতপূর্বই নয়, বরং মার্কিন নেতৃত্বাধীন একমেরুর বিশ্বব্যবস্থা কে অগ্রাহ্য করারও একটি ইঙ্গিত। চীনের রাশিয়ায় রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৫% ও আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৮.৬%, যা যুদ্ধের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি চীনের সুপ্ত সমর্থনকে ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে চাপানো নিষেধাজ্ঞা কে অমান্য করার একটি প্রবল নিদর্শনও বটে।
চীনের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান (ASEAN) গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি, যাদের সাথে চীন মোট ৯,৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য করেছে ২০২২ সালে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
যেহেতু চীন-বিরোধী সামরিক জোট গড়ার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র “ইন্দো-প্যাসিফিক” থিয়েটার বলে একটি যুদ্ধ ফ্রন্ট দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খুলেছে ও ভারত এবং ASEAN দেশগুলো সহ নানা আঞ্চলিক শক্তি কে চীন বিরোধী সামরিক অক্ষে সামিল করাতে জোর দিচ্ছে, তাই এই পরিপ্রেক্ষিতে চীন-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়া আর ASEAN দেশগুলোর সাথেও চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধি যে মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের হতাশ করবে সেটা আশ্চর্যের কথা না।
ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সমস্যা
ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে, ও ভারতে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া চীন-বিরোধী উগ্র-জাতীয়তাবাদী রাজনীতির, যাতে শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও বিরোধী কংগ্রেস সহ সব মূলস্রোতের দল মোটামুটি জড়িত, থেকে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য যে মুক্ত থেকেছে ও বৃদ্ধি পেয়েছে এটা একটি আশার ঘটনা।
কিন্তু দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে দেখতে গেলে এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ফলে ভারতের সার্বিক বাণিজ্যিক ঘাটতি খুবই চিন্তার বিষয়। সরকারি তথ্য অনুসারে এপ্রিল থেকে নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ১২,৭৫৫ কোটি মার্কিন ডলারের ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয়। যার মধ্যে ভারতের আমদানি হল ৬,৯৩৩ কোটি মার্কিন ডলারের, যা ২০২১ সালে ছিল ৬,৫৬৫ কোটি মার্কিন ডলার, আর রফতানি হল ৫,৮২২ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য ও পরিষেবা, যা ২০২১ সালে ছিল ৫,২৪৬ কোটি মার্কিন ডলার।
এপ্রিল-নভেম্বর ২০২২ এর মধ্যে ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারতের ঘাটতি হল ১,১১১ কোটি মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালের ১,৩১৯ কোটি মার্কিন ডলারের থেকে সামান্য কম হলেও, পরিষেবা বাদে কোনো ক্ষেত্রেই ভারতের রফতানিতে সার্বিক ভাবে চোখে পড়ার মতন বৃদ্ধি হয়নি।
বর্তমানে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঘাটতি ক্রমবর্ধমান থাকায়, বিদেশী মুদ্রা আয় হ্রাস পাচ্ছে ও টাকার দামের উপর তার প্রভাব পড়ছে। যদিও ভারত রাশিয়ার থেকে, মার্কিন চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে, টাকা-রুবল ভিত্তিতে তেল আমদানি বৃদ্ধি করেছে ২০২২ সালে, কিন্তু চীন বা অন্য দেশের সাথে নিজ মুদ্রায় ভারত বাণিজ্য করা শুরু করেনি।
চীনের থেকে আমদানি কমানোর কথা বলা হলেও, বিশেষ করে ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকায় চীনা গণমুক্তি ফৌজ ও ভারতীয় সেনা বাহিনীর মধ্যে হাতাহাতি সংঘর্ষে অনেক সৈনিকের মৃত্যুর পর থেকে, ভারতের চীনের থেকে আমদানি কমেনি, বরং বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় ভারত যে চীনে রফতানি বাড়াতে পারছে না, তার কারণ সামগ্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে
পরিকাঠামোগত ভাবে ও শিল্প বিকাশের দিক থেকে চীনের থেকে পিছিয়ে থাকায় ভারতের পক্ষে বর্তমান পরিস্থিতিতে চীনের সাথে আর্থিক প্রতিযোগিতা করা অসম্ভব। কিন্তু চীনের বর্তমান আর্থিক বৃদ্ধি থেকে ভারতের লাভ তোলা উচিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি করে। শ্রম শক্তির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে চীনের মতন ব্যাপক হারে ভারতেরও জনস্বাস্থ্য ও জনশিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্যে বিনিয়োগ করা উচিত। শ্রম শক্তির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারত বিদেশী পুঁজির লগ্নি শিল্প ও পরিকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে আকর্ষণ করতে পারে, যা পরিষেবার তুলনায় পণ্য উৎপাদন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি মেটাতে কাজে আসতে পারে।
শি জিংপিং এর আমলে সিপিসি যেহেতু চীনা ও বিদেশী পুঁজির অধীনস্থ সংস্থাগুলোর উপর কোপ মারছে, ফলে নিজের পরিকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে ভারত সেই সমস্ত বৃহৎ সংস্থাগুলোকে ভারতের শিল্প ও পরিকাঠামো উন্নয়নে লগ্নি করতে আকর্ষিত করতে পারে, যা দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার ভিত্তিতে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে ও ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহ ভারতের সামগ্রিক বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়াতে ও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।