লেবাননের গবেষক আদম সাঈদ, গত নয় বছর ধরে চীনে বসবাস করছেন। সাঈদ চীন এবং আরব দেশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেন। এছাড়াও তাঁর গবেষণা লব্ধ বই, ‘This is how it was in Wuhan: Diaries of Quarantine Days’, বিভিন্ন মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সম্প্রতি আয়োজিত ১৪তম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ফোরামে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এই উপলক্ষে সাঈদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইস্ট পোস্ট বাংলার তরফ থেকে শ্রেয়সী চৌধুরী।
শ্রেয়সী: বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ফোরামে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সাঈদ: বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ফোরামে এটি আমার প্রথম অংশগ্রহণ নয়; গত বছরও আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেই বার সেখানে প্রায় ৮০ জন বিদেশি ছিলেন, এই বছর কিছু কম হলেও সেখানকার অভিজ্ঞতা এখনও আকর্ষণীয়। বিশ্বব্যাপী মার্কসবাদী চিন্তাধারার মানুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ মেলে, যা আমার জন্য মধুর অভিজ্ঞতা।
শ্রেয়সী: কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে ফোরামে আপনার ভূমিকা কী ভাবে প্রভাবিত হয়েছে?
সাঈদ: লেবাননের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং একাডেমিক হিসেবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল গাজা ও লেবাননের যুদ্ধের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা। বিশেষ করে ইউরোপীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যে সঠিক অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা। একাডেমিক সম্মেলন হিসেবে, আমাদের লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাজকর্ম এবং এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা।
শ্রেয়সী: সম্প্রতি সাম্রাজ্যবাদী মেকানিজমের বিস্তারিত ব্যাখ্যা কী ভাবে করবেন?
সাঈদ: বর্তমানে আমরা একটি উন্নত এবং সংঘাতপূর্ণ দুনিয়ায় বসবাস করছি যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে যুদ্ধ ও সংকট তৈরি করে ক্ষমতা রক্ষা করছে। সামির আমিনের তত্ত্ব অনুযায়ী, সাম্রাজ্যবাদ আজ এক গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে, যা যুদ্ধ এবং ধ্বংসের মাধ্যমে সমাধান খুঁজছে।
শ্রেয়সী: এই ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা নিয়ে আপনার মতামত কী?
সাঈদ: চীন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও সমঝোতার প্রচেষ্টা করছে, যেমন সৌদি ও ইরানের মধ্যে চুক্তি। তবে গাজা ও লেবাননের যুদ্ধের মধ্যে চীনের নীতি সীমাবদ্ধ, কারণ যুদ্ধের পরিবেশে অন্যান্য কূটনৈতিক প্রয়াস কার্যকর হতে পারে না। চীন এখনও ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করছে এবং যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করছে, তবে এই পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়।
শ্রেয়সী: ইউরোপীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলির অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে কি?
সাঈদ: হ্যাঁ, ইউরোপে অনেক কমিউনিস্ট পার্টি এখন সঠিক অবস্থানে পৌঁছেছে। প্রথমে তাদের অবস্থান অস্পষ্ট ছিল, কিন্তু বর্তমানে তারা গাজায় গণহত্যার ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারছে।
শ্রেয়সী: ফিলিস্তিনের প্রশ্ন বিশ্ব সমাজতন্ত্র গঠনের প্রক্রিয়ার ভবিষ্যতের উপর কী প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন?
সাঈদ: ফিলিস্তিনের সমস্যা বর্তমান যুগের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। যদি আমরা এই যুদ্ধ জিততে পারি, তবে এটি বিশ্বে মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে। ইসরায়েল বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার একটি কেন্দ্রবিন্দু এবং এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম নতুন সমাজতান্ত্রিক ভবিষ্যতের নির্মাণের একটি অংশ।
শ্রেয়সী: এই সংঘাতের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন? কোনো শান্তির আশা আছে কি?
সাঈদ: বর্তমান সংঘাতের সমাধান অত্যন্ত কঠিন। ইতিমধ্যে এক বছর পেরিয়ে গেছে এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে চায়, তারা এক ঘণ্টার মধ্যে তা করতে পারে। তবে, তারা যুদ্ধ বন্ধ করতে আগ্রহী নয়। ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং শান্তির জন্য কোনো সুস্পষ্ট সম্ভাবনা নেই।
শ্রেয়সী: ৭ই অক্টোবরের ঘটনা ইসরায়েলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
সাঈদ: ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল। ইসরায়েল নিজেই বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ইসরায়েলি রাজনীতিবিদরা এবং যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবেই জানে যে ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ বিপন্ন। তারা জানে, যুদ্ধ থামলে ইসরায়েলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে, এমনকি সম্ভবত অভ্যন্তরীণ যুদ্ধও শুরু হতে পারে।
শ্রেয়সী: যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
সাঈদ: যুক্তরাষ্ট্র চাইলে সহজেই যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে, কিন্তু তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়। ইসরায়েলের রাজনীতিবিদরা জানে, যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তারা কিছু একটা অর্জন করতে পারে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিকে আড়াল করতে সাহায্য করবে।
শ্রেয়সী: চীনের ভূমিকাকে কী ভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সাঈদ: চীন তার নিজস্বভাবে সমস্যার সমাধান করতে চায়, এবং তারা কখনো যুক্তরাষ্ট্রের মতো খেলায় অংশ নিতে চায় না। চীনের মডেল যুদ্ধ এবং সংকটের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে না; তাদের মডেল মূলত বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। ফলে, চীন গাজা সংকটের মতো আন্তর্জাতিক সংকট সমাধানে সীমিত ভূমিকা রাখতে পারে।
শ্রেয়সী: চীনের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ কী হতে পারে?
সাঈদ: চীন নতুন বিশ্বের রাজনীতি গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। তাদের পূর্বের কৌশলগুলি এখন নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মেলানো কঠিন। চীন তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইবে এবং যুদ্ধের বিরোধিতা করবে, তবে তারা জানে যে এটি একটি নতুন বাস্তবতা এবং তাদের এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। নতুন পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে হবে। একটি নতুন বিশ্ব নির্মাণের কাজ পুরোনো বিশ্বের নিশ্চিহ্নিকরণের মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব।