সৌদির চিঠি পর্ব ৩২
সোহেলরা ট্রান্সফার পেলো না। কোম্পানি ওদের হেনস্থা করার জন্য শেষমেশ ওদের একেবারে ফাইনাল এক্সিট দিয়েই বিদায় করলো, এবং ওদের নতুন কোম্পানিও একটু বোকা বনে গেল এই বিষয়ে। সোহেলরা চেয়েছিল যাতে ওদের সাথে হওয়া এই চুক্তি জালিয়াতির জন্য ওদের ট্রান্সফার দিয়ে রেহাই দিক, কারন এক্সিট দিয়ে দিলে আবার নতুন ভিসা বানিয়ে টিকিট করিয়ে সৌদি আসা অনেক ঝামেলা, আর খরচার ব্যাপার। তাই আমরা অনেকেই নতুন চাকরি খুঁজতে যাওয়ার সময়ে ফেঁসে যাই কারন বেশিরভাগ কোম্পানি ওই নতুন ঝামেলা পোহাতে না চেয়ে বদলি করানো যায় এমন ইকামা অথবা পারমিট থাকা শ্রমিক খোঁজে। আমার সেরকম ছিল না বলে অনেক ভালো ভালো চাকরির প্রস্তাব খুইয়েছি।
সোহেল আর রিয়েল(নাম পরিবর্তিত) রাও এখন এই ঝামেলায় পড়লো কারন তাদের ট্রান্সফারেবল ইকামা থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি নিজেদের রাগ মেটানোর জন্য তাদের এইরূপ হেনস্থার মুখে ফেলে দিল। ইতিমধ্যেই তারা তাদের নতুন কোম্পানিতে কাজ শুরু করে দিয়েছে, এবং তাদের কাজ পছন্দ হয়েছে বলেই নতুন ওপরওয়ালারা আশ্বস্ত করেছেন যে এক্সিট নিয়ে বেরোনোর পর তাড়াতাড়ি আবার তাদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এই সমস্ত হচ্ছে মৌলিক আশ্বাস, যার কোনো লিখিত ভিত্তি নেই। এবার সেই নিয়ে যে কিরকম পরিনতি হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই আলাদা করে আর বলতে হবে না! আগের পত্র গুলোয় যেমন লিখেছিলাম, যখন তাদের “আনভেরিফায়েড” চুক্তি তে সই করিয়ে নিয়ে চুক্তি বদলে দেওয়া হচ্ছে, তখন আর মৌলিক আশ্বস্তিকরণের কিই বা মূল্য থাকে…
অনেক রকমের আশঙ্কা থেকেই যায় কারন আমরা ইতিমধ্যে হরেক রকমের কীর্তি দেখতে নিয়েছি। কীর্তি না বলে রঙ্গ বললেও চলে অবশ্য। রিয়েলের বাসা আমার বাপ দাদার মিটার কাছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর তীরে। সেই সূত্রে আমাদের পারিবারিক ভাবে সেলাম আদান প্রদান হয়। ওর এক দুলা ভাইয়ের কাহিনী শুনিয়েছিল আমায়। ভদ্রলোক দীর্ঘ দশ বছর দুবাইয়ে এক বিখ্যাত পুরস্কারপ্রাপ্ত জাপানি রেস্টুরেন্টে কাজ করে মহামূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিয়ে রিয়াদে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি রিয়াদে যেই রেস্তোরাঁয় ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হলেন সেখানেই রিয়েলদের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এবার হঠাৎ ব্যবসার মুনাফার ঘাটতি শুরু হতে মালিকরা দিশেহারা হয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তখন তারা এক অদ্ভুত কান্ড ঘটালো। যারা যারা ছুটির আবেদন দিয়ে রেখেছিল, তাদের সবার ছুটি মঞ্জুর করে দিল। নতুন যারা চাইছিল তাদেরও তৎপরতার সাথে সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে জানালো যে তারা ছুটি থেকে ফিরলে ব্যবসায়িকভাবে কিছু নতুন পরিবর্তন দেখবে, ততদিন সেইসব নিয়েই কাজ এগোতে থাকবে এখানে, তারা যেন নিশ্চিন্তে ততদিন তাদের পাওনা ছুটি গুলো উপভোগ করে আসে।
কোম্পানির একরকম রিভ্যাম্পিং অথবা আগাগোড়া পরিবর্তনের কথা তার মানে। হোটেল লাইনে এইরকম কাজ লেগেই থাকে। তাই সবাই আনন্দের সাথেই নিজের নিজের দেশে ফিরে গেল। তারপর আসল ঝামেলা সামনে এলো। বোঝা গেল, যে মালিক এতই নাজেহাল ব্যবসা সামলাতে গিয়ে, যে সে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ধার দেনা নিয়ে এতই নাস্তানাবুদ যে সে সমস্ত কর্মীদের ছুটিতে পাঠিয়ে তাদের আর ফেরত ডাকলো না। সচরাচর এই ক্ষেত্রে যা হতে পারে তা হচ্ছে ছুটি তে পাঠিয়ে তাদের বদলে সস্তায় নতুন কর্মী রেখে দেবে হয়তো। কিন্তু এই ক্ষেত্রে মালিক একেবারে পাততাড়ি গুটিয়ে গায়েব হয়ে গেল! কর্মীদের যদি সঠিকভাবে চুক্তি শেষ করিয়ে বিদায় জানাতে হয় তাহলে তাতে অনেক খরচা হয়ে যাবে তাদের বকেয়া সমস্ত টাকা মেটাতে গিয়ে। তাই মালিক সমস্ত স্টাফ, এমনকি প্রধান শেফ কেও তার দেশ শ্রীলঙ্কায় এই ভাবে ফেরত পাঠিয়ে দিল। এবার ছুটি গিয়ে যদি ফেরত না আসে তাহলে তাদের পাসপোর্টে হুরুপ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছর আপনি আর সৌদি ফেরত আসতে পারবেন না। ওদিকে রিয়েলের জামাইবাবু নিজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল, এমনকি দুবাইয়ে কাজ করার অত এক্সপিরিয়েন্স লেটার, সমস্ত কিছু নিজের রিয়াদের ঘরেই ছেড়ে এসেছিলেন, যেগুলো রুম সাফাইয়ের সময়ে চিরকালের মতো হারিয়ে গেল। তার যে কি চূড়ান্ত ক্ষতি হয়ে গেল তা আমরা বাইরে থেকে কখনোই অনুভব করতে পারবো না…