সৌদির জন্য রওনা হওয়ার আগে সমস্ত মানুষের এক মেডিকাল পরীক্ষা হয়। নাহলে ভিসা হয়না। সমস্ত ভাবে সুস্থ বিচার হলে তারপরেই সৌদির ভিসার যোগ্য হওয়া যায়, কারন এখানে সমস্ত কোম্পানি নিজেদের কর্মীদের জন্য মেডিকেল ইনসিওরেন্স দিতে বাধ্য। তাই যে কাউকে স্বাস্থ্য বীমা কেউ কেনই বা দেবে যদি তার কোনো পুরোনো রোগ থাকার সম্ভাবনা থাকে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কোনো অসুস্থ মানুষকে কেউ এত ভিসা এবং থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা দিয়ে পয়সা দিয়ে নিয়ে আসবেই বা কেন। কোনো বুদ্ধিমান মালিক অথবা কোম্পানি সেটি করতে চাইবে না। তাই খুঁটিনাটি পরীক্ষা না হলে কেউ সৌদির ভিসা পায় না, যেখানে বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রে এত না দেখলেও চলে।
তাই এইসবের পরে যদি আমাদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে বোঝাই যায় যে এই দেশে আসার পরে রোগ বাঁধিয়েছে। তখন কোম্পানির দায়িত্ব হয় ইনসিওরেন্সের মাধ্যমে তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া। তাই আমার সাথে যখন কিচেনে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তখন আমি হাসপাতালে সমস্ত ঔষধ, ফার্স্ট এইড এবং ড্রেসিং এর খরচা পাতি পেয়েছিলাম। যেকোনো কারুর পাওয়া উচিৎ। কিন্তু একবার আমাদের মধ্যে একজন ভারতীয়, নরেশ(নাম পরিবর্তিত), উনি ওনার চেকআপের জন্য কোনও ভরপাই পাননি। প্রায় আট বছর আগে ওনার একটা মোটরবাইক দুর্ঘটনার জন্য ডান কাঁধের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, যেটা তখ ঠিক ঠাক মতো জোড়া লাগানো যায়নি এবং ডাক্তার সাবধান করে দিয়েছিলেন যে এমন বেকায়দায় ভেঙেছে যে এটার আলাদা ভাবে আর কিছু করার তাই সাবধানে রাখতে সারা জীবন। এখন হঠাৎ আবার সেই অংশে যন্ত্রনা শুরু হতে ডাক্তারের চেকআপে যাওয়ার সময়ে দেখা গেল যে সেটা ইনসিওরেন্সের আওতায় নেই কারণ এই ব্যাথার কারন অনেক পুরোনো, ভারতে থাকতেই হয়েছিল। মেনে নিলাম।
কিন্তু এক অত্যন্ত গুরুতর রোগের জন্য যদি সঠিক সাহায্য না দেওয়া হয়, তাহলে অবস্থা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে আশঙ্কাজনক হয়ে উঠতে পারে। বিশালের(নাম পরিবর্তিত) সাথে তাই হলো। ওর দুটো কিডনি তে পাথর জমে পচন ধরে গেছে। এটার জন্য আমরা ওকেই দোষ দি কারন ও হাড়কিপ্টে। ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা বিশাল এক গরীব পরিবারের বড়ো ছেলে। চূড়ান্ত হিসাব নিকাশ করে চলে, বিদেশে আসার পর থেকে এই দুই বছরে খিচুড়ি ছাড়া আজ অবধি অন্য কিছু ঘরে বানিয়ে খায়নি। জলের দামের জন্য ভীষণ কম জল খেতো যার কারনে আজ এই দশা। কিন্তু নিজের ঘর পরিবারের কথা ভেবে দুই বছরের চূড়ান্ত অমানুষিক অবহেলা যুক্ত পরিশ্রমের পরেও আমাদের সাথে চাকরি ছাড়লো না, পেটের দায়ে কোম্পানির পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু যেই সেই পরিশ্রম এবং নিজের প্রতি অবহেলার জন্য এই ভীষণ রোগ বাঁধিয়ে ফেললো, কোম্পানি হাত তুলে ফেললো।
ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, দুটো কিডনি অপারেশন করে পাথর আর ইনফেকশন বার করতে হবে এছাড়া উপায় নেই। বিশাল এদিকে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে মাটিতে পড়ে। দুটো কিডনি অপারেশনের যা খরচ সেটি শুনে যেন বেদনা আরো বেড়ে গেল। কোম্পানি কে মেইল করা হলো স্বাভাবিক ক্ষেত্রে যেহেতু স্টাফের ইনসিওরেন্সের জন্য এক লক্ষ রিয়াল, অর্থাৎ বাইশ লক্ষ ভারতীয় মুদ্রা বরাদ্দ থাকে, তাই এই অপারেশনের জন্য যাতে সেই ফান্ড দেওয়া হোক। কিন্তু কোম্পানি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে জানিয়ে দিলেন যে এত দামি চিকিৎসার খরচ দেওয়া সম্ভব নয়। শেষমেশ অনেক কাকুতিমিনতি করে হাতে পায়ে ধরার পর শুধু একটা কিডনি অপারেশনের টাকা ছাড়া হলো। ডাক্তার বারবার দুটো কিডনির কথা বলা সত্ত্বেও এর বেশি আর বিমার বরাদ্দ হলো না। যেই কিডনি তে বেশি পচন ধরেছিল, মানে ডান দিকেরটাই কেটে জুড়ে দেওয়া হলো। বাঁদিকের যন্ত্রনা এবং একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে বিশাল ঘরে ফিরে এলো। শুনলাম এখন নাকি দিনে ছয় লিটার করে জল খাচ্ছে! কিন্তু এই ঘটনার পর আমরা সকলেই কর্পোরেট এর এই নিষ্ঠুর চেহারা দেখে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম।