Close

বিশ্বজুড়ে নাম বদলের ইতিহাসে ‘ভারত’ খাপ খাচ্ছে কি?

দেশের নাম বদলের জল্পনা চলছে চারিদিকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাম বদলের ইতিহাস কী বলছে? লিখছেন সৌম মণ্ডল।

দেশের নাম বদলের জল্পনা চলছে চারিদিকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাম বদলের ইতিহাস কী বলছে? লিখছেন সৌম মণ্ডল।

দেশের নাম বদলের জল্পনা চলছে চারিদিকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাম বদলের ইতিহাস কী বলছে? লিখছেন সৌম মণ্ডল।

সাল ১৯৮৯, সামরিক জুন্টা বনাম বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির গৃহযুদ্ধে দীর্ণবিদীর্ণ ভারতের প্রতিবেশী দেশটি নিজের নাম বদলে নিয়েছিলো। দেশটিতে বার্মিজ, কাচিন, কারেন, শান, রোহিঙ্গা সহ ৫১টিরও বেশী নৃগোষ্ঠীর মানুষের বাস। যদিও শাসন ক্ষমতার মূলত বার্মিজদের হাতে।

সামরিক জুন্টা দেশের নাম বর্মা থেকে বদলে মায়ানমার করে দিলো। জুন্টা শান্তি আলোচনায় বসলো অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর নেতাদের সাথে। সামরিক জুন্টা সরকার বার্তা দিতে চেয়েছিলো বর্মা শুধু বার্মিজদের নয়, সমস্ত জনজাতির। সবার দেশ মায়ানমার।

বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর নেতারা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো, নেতাদের আক্রমণ করলো। পার্টির নেতারা প্রাণ বাঁচাতে চীনে আশ্রয় নিলো। অন্যদিকে নৃগোষ্ঠীর নেতারা শান্তি চুক্তি করলো মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকারের সাথে। যদিও দেশের নাম বদলিয়ে নিজের দেশ অনুভূতি জাগ্রত করার প্রচেষ্টা হলেও, মায়ানমারের শাসন ক্ষমতায় থাকলো বার্মিজ সম্ভ্রান্তদের হাতেই, তা সে সুকি বা সেনা জুন্টা যার শাসনেই হোক! তাই শান্তি চুক্তির ২০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই আরার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় মায়ানমারে। জনজাতিরা নিজেদের সেনা বাহিনী বানিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে সুকি বা সমস্ত মায়ানমার সেনা সরকারের বিরুদ্ধে।

ভারতের উত্তরে প্রতিবেশী দেশ নিজেদের চুংগুয়ো নামে জানলেও গোটা পৃথিবী তাদের চায়না বা চীন নামে জানে। চীনে বর্তমান শাসক দল ব্যাপক উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ক্ষমতায় এলেও, বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা বিরোধীতার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠলেও দেশের সরকারি নাম কিন্তু “চায়না” থেকে “চুংগুয়ো” করে দেওয়া হয়নি।

বিপ্লবের আগে চীনে খুব সামান্য অংশের মানুষই সাক্ষর ছিলেন, কারণ চীনা ভাষার লিখিত রূপ শেখা খুব জটিল। ফলত গৃহযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট পার্টির বার্তা প্রেরণ বা প্রচারে অসুবিধা হত। তখন চীনা কমিউনিস্টরা রোমান হরফে চীনা শিক্ষা দেওয়ার কর্মসূচি নেন। যাতে দ্রুত মানুষ লিখতে বা পড়তে পারে। উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বা মাটির সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেওয়ার সাথে কাজের সুবিধা বা মানুষের বোঝার সুবিধার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন তারা।

খ্রীস্টপূর্ব ৩০৫ অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২৩০৫ বছর আগে গ্রীস থেকে সম্রাট সেলুকাসের দূত হিসেব মেগাস্থিনিস ভারতে তৎকালীন শাসক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় আসেন। ম্যাগাস্থিনিসের ভারত বিবরণের নাম ইন্ডিকা। ঐতিহাসিকরা বলছেন ব্রিটিশরা ভারতে আগমনের বহু আগে থেকেই সিন্ধু পাড়ের অঞ্চলটিকে সিন্ধু অপভ্রংশ ইন্ডু, হিন্দু ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করা হত। সেখান থেকেই ইন্ডিয়া, হিন্দু বা হিন্দুস্থান কথাটি এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। সেই হিসেবে ইন্ডিয়া বা হিন্দু শব্দগুলো বিদেশীরা জন্ম দিয়েছে। ইন্ডিয়াতে আপত্তি থাকলে হিন্দুতেও থাকা উচিৎ। এবং আক্ষরিক অর্থে আসলেই ইন্ডিয়া বা হিন্দুস্থান আসলে পাকিস্তানের ভেতর রয়ে গেছে।

অন্যদিকে ভারত নামটি পাওয়া যায় পৌরাণিক কাহিনীতে। মান্য ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী পুরাণ আর্যদের রচিত। আর্যরা আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে আফগানিস্তানের পথে ভারত ভূখন্ডে প্রবেশ করে। আর্য শাসন কখনোই বঙ্গ বা বর্তমান উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করেনি। সুতরাং সেই অর্থে বঙ্গদেশ প্রাচীন ভারতের অংশ ছিলো না।

কিন্তু হঠাৎ দেশের নাম নিয়ে এত বিতর্ক কেন? রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মূর সাক্ষরিত G20 শীর্ষ সম্মেলনের আমন্ত্রন পত্রে সরকারি ভাবে “প্রেসিডেন্ট অফ ভারত” লেখা হয়। “প্রেসিডেন্ট অফ ভারত” লেখাতে কোনো সাংবিধানিক সমস্যা নেই। কারণ ভারতের সংবিধানের প্রথম ভাগের প্রথম ধারাটিতে লেখা আছে, “ইন্ডিয়া অর্থাৎ ভারত, রাজ্যসমূহের সংঘ হইবে।” অর্থাৎ ইতিমধ্যে দেশের সরকারি নাম দুটি ইন্ডিয়া এবং ভারত। যদিও এত দিন ইন্ডিয়ার সমার্থক হিসেবে ভারত নামটা আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহার করা হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া নামটিই ব্যবহার করা হত। এবার আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত নামটি ব্যবহার স্বীয় ভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর পর মিডিয়ার একাংশ “আভ্যন্তরীণ সূত্র” এর বরাত দিয়ে প্রচার চালাতে শুরু করে আগামী সেপ্টেম্বর এর সংসদ অধিবেশনে দেশের নাম ভারত করে দেওয়া হবে। যদিও আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ইতিমধ্যে দেশের নাম ভারত। নতুন করে ভারত নামকরণের কোনো জায়গা নেই। ভারতের বিকল্প হিসেবে ইন্ডিয়ার অবলুপ্তি হতে পারে মাত্র।

বর্মা থেকে মায়ানমার হওয়ার পেছনে ঐক্যের বার্তা দেওয়ার একটি উদ্দেশ্য ছিলো। চীন, জার্মানি সহ বিভিন্ন দেশ তাদের দুইরকম নাম রাখার পেছনেও কাজের সুবিধার যুক্তি আছে। কিন্তু ভারত বনাম ইন্ডিয়া চর্চার উদ্দেশ্য বা কার্যকারিতা ঠিক কী?বলাবাহুল্য হঠাৎ ইন্ডিয়া সরিয়ে ভারত করা হলে, দলিল পত্রে নাম ঠিক করতে অনেক হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে নাগরিকদের। বিরোধী জোটের নাম I.N.D.I.A রাখার প্রেক্ষিতেই কি বিজেপির দলীয় স্বার্থে দেশের নাম সংশোধনের বিতর্ক উসকে দেওয়া? এই প্রশ্ন উঠবেই।

সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

Leave a comment
scroll to top