Close

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন: কী বলছেন প্রতিরোধে সামিল স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থীরা?

একদিকে যখন ঢাকায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে বিক্ষোভ করছে নানা সম্প্রদায়ের মানুষ তখন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদানে নিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবকদের অভিজ্ঞতা কী বলছে?

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে যখন শাহবাগ থেকে ভারতের মিডিয়া উত্তপ্ত হয়েছে তখন তাঁদের নিরাপত্তা প্রদানকারী স্বেচ্ছাসেবকেরা কী বলছেন?

ছবি সত্ত্ব - ফাহিম

বাংলাদেশে ছাত্রছাত্রীদের রক্তাক্ত সংগ্রামের ফলে ক্ষমতার আলিন্দ থেকে শেখ হাসিনা বিদায় নেওয়ার পরে যেমন দেশের চতুর্দিকে জন উচ্ছাস দেখা গেল, তেমনি পড়শি ভারতের হিন্দি ও ইংরাজি মিডিয়া তুলে ধরলো যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নাকি তীব্র দমন পীড়ন শুরু করেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমেরা। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বাংলা সংবাদ মাধ্যমও দিল্লীর সুরে সুর মেলালো। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন, নির্দিষ্ট করে বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন, নিয়ে মেতে উঠলো ভারতের মিডিয়া ও রাজনীতি।

কিন্তু এই অভিযোগের বন্যার মাঝে জানা দরকার সত্যিই গত ৫ই অগাস্ট থেকে, অর্থাৎ যে দিন হাসিনার পতন হলো—এবং যে দিনটিকে বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব সমাজ জুলাই মাসের ৩৬ তারিখ হিসাবে গণ্য করেছেন তাঁদের ভাই বোনের রক্তে স্নাত জুলাই মাসকে ‘স্বৈরতন্ত্রের পতন’ না হওয়া পর্যন্ত শেষ না হতে দেওয়ার অঙ্গীকার থেকে—সেদিন থেকে বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন বা সংখ্যালঘু নিপীড়নের সঠিক চিত্রটি কী রকম।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন  

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন তীব্র আকার ধারণ করে হাসিনার পতনের পর থেকে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের (বিএইচবিসিইউসি) ডাকে ঢাকার ঐতিহাসিক শাহবাগে কয়েক হাজার হিন্দু ধর্ণা প্রদর্শন করছেন দেশ জোড়া সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে। বিএইচবিসিইউসি নেতা অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত জানিয়েছেন যে বাংলাদেশে নাকি ২০৫টি সংখ্যালঘু বিরোধী হিংসার ঘটনা ৫ অগাস্ট এর পর থেকে হয়েছে। এর প্রতিবাদে যেমন বিএইচবিসিইউসি, পূজা উদযাপন পরিষদ ও সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চা প্রতিবাদ করছে তেমনি তদারকি সরকারের কাছে তাঁরা অনেকগুলো দাবি তুলে ধরেছেন যার মধ্যে অন্যতম হলো সংখ্যালঘুদের জন্যে জাতীয় সংসদে সংরক্ষণ, সরকারে তাঁদের জন্যে মন্ত্রক ও তাঁদের সুরক্ষা প্রদানের বন্দোবস্ত করা। 

এর সাথে দাশগুপ্ত দাবি করেছেন যে যাঁদের উপর হামলা হয়েছে সেই নিপীড়িতদের ন্যায় প্রদান করা, তাঁদের দখল হওয়া জায়গা জমি ফিরিয়ে দেওয়া, প্রভৃতি। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ছাত্র যুবরা বারবার সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ রোধের বন্দোবস্ত করছেন, পাহারা দিচ্ছেন বলে দাবি করছেন, পুলিশের অনুপস্থিতিতে তাঁদের উপর চরম অত্যাচার হচ্ছে বলে বিএইচবিসিইউসি, পূজা উদযাপন পরিষদ ও সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চা দাবি করছে। 

এর মধ্যে আবার ভিন্ন মত শোনা যাচ্ছে একটি অন্য মহল থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশের এক সাংবাদিকের দাবি যে যেহেতু হাসিনার শাসন কালে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড় অংশটি সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী জামাত-এ-ইসলামীর আতঙ্কে ও সরকারি সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয় তাই দেশজোড়া আওয়ামী-বিরোধী আন্দোলনের আবহে প্রাক্তন শাসক দলের নেতা কর্মীদের মতনই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপরেও আক্রমণ নেমে আসছে।

কিছু ছাত্র লীগের কর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতের অতি-দক্ষিণ হিন্দুত্ববাদী শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) স্লোগানের — জ্যায় সিরি রাম — বাংলা সংস্করণ জয় শ্রী রাম ব্যবহার করতে দেখা যায়। অনেকে আবার নিজেদের নাম দেবনগরী অক্ষরে লেখাও শুরু করে দিয়েছেন। 

এর মধ্যে কয়েক’শ বাংলাদেশী হিন্দু উত্তর বঙ্গের কোচবিহার সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে চাইলে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ তাদের রুখে দেয় ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের ফেরত পাঠায়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নয়া দিল্লী। 

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে এই ঘটনায় গত লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়া মোদীর বিজেপির পালে হাওয়া লাগতে পারে, বিশেষ করে আগামী হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও দিল্লীর নির্বাচনে। 

তদারকি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনুসের প্রতি তাঁর শুভেচ্ছা বার্তাতেও মোদী বাংলাদেশের হিন্দুদের সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যদিও বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। 

সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ প্রতিহত করছেন শিক্ষার্থীরা

চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামেই সংখ্যালঘুদের উপর হামলায় আটজন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে চট্টগ্রাম আনোয়ারা উপজেলার থেকে তরুণ স্বেচ্ছাসেবক সজীব নাথ জানালেন যে ৫ই অগাস্ট থেকে তিনি ও অঞ্চলের যুবরা সার্বিক ভাবে অঞ্চলে শান্তি রক্ষার কাজ করছেন। তাঁর দাবি প্রতিটি ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডে তিনি ও তাঁর সহযোগী যুবরা পাহারা দিয়েছেন, রাত্রিকালীন পাহারা দিয়েছেন এবং এই অঞ্চলে কোনো ধরণের সমস্যা হয়নি। 

“হ্যাঁ, মানুষ নিরাপদে আছে। এখানে কোনো সমস্যা হয়নি আপাতত। কোনো সমস্যা দেখা দিলে আমাদের টিম গিয়ে ওদের সহযোগিতা করেছে,” নাথ ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানালেন।

“আমাদের একটি মন্দিরে, সরকারের পতনের পর পরই জোর জবরদস্তি দখলের চেষ্টা করেছিল সেটা আমরা তাড়া করে দিই, এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতা আমরা পাই”

ডাকাতি ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে জিজ্ঞাসা করায় নাথ জানালেন যে, “এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি তবে আমাদের একটি মন্দিরে, সরকারের পতনের পর পরই জোর জবরদস্তি দখলের চেষ্টা করেছিল সেটা আমরা তাড়া করে দিই, এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতা আমরা পাই।”

“তবে চট্টগ্রামের যেসব স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হয়েছে, সেই সব আক্রমণের জন্যে শুধু সংখ্যালঘু (পরিচয়) একমাত্র কারণ ছিল না। রাজনৈতিক কারণ, পূর্বের চলমান বিবাদ (রাউজানে সবচেয়ে বেশি বাড়িঘরে হামলা হয়েছে, ওখানকার সবগুলোই রাজনৈতিক কারণ, যদিও এলাকাগুলো সংখ্যালঘুদেরই ছিল) এমন কারণ সমূহের জন্য। কিছু জায়গায় আক্রমণের সম্ভাবনা তৈরী হলে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে, কিছু স্থানে স্থানীয়রাই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, কিছু জায়গায় আবার আমাদের ভলান্টিয়ার ভাইয়া-আপুরা এগিয়ে গিয়েছে, ইন্সটেন্ট রেস্পন্স এর জন্য,” জানালেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা ও ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক আদিল রায়হান।

“চট্টগ্রামের বাইরেও উত্তর বঙ্গের দিকে হিন্দুদের উপর আক্রমণের কথা শুনেছি, যেটা ওদের ধর্মীয় কারণে করা হয়েছে এবং কিছুক্ষেত্রে সত্যতাও পেয়েছি,” তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানান। 

কী ভাবে এই তরুণরা পুলিশের অনুপস্থিতিতে রক্ষা করছেন মানুষকে, বাঁচিয়ে রাখছেন বাংলার জাতীয়তাবাদ কে ও লড়ছেন সাম্প্রদায়িকতার সাথে, তাও আবার খালি হাতে?

“চট্টগ্রামের বাইরেও উত্তর বঙ্গের দিকে হিন্দুদের উপর আক্রমণের কথা শুনেছি, যেটা ওদের ধর্মীয় কারণে করা হয়েছে এবং কিছুক্ষেত্রে সত্যতাও পেয়েছি”

“আমরা মোটামুটি হাজারের কাছাকাছি ভলান্টিয়ার আছি। আমরা শুরুতে যে কোনো স্থানে আক্রমণের কথা শুনলে বন্ধুদের সাথে ওই জায়গায় দ্রুত গিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করতাম (এখনো কোনোটা আসলে প্রতিহত করতে হয়নি), আর প্রথম দিকে সেন্ট্রালের মন্দির গুলো/ রিস্ক জোনগুলোরে রাতে পাহারা দিতাম। এখন চাঁদাবাজি বৃদ্ধি পাওয়ায় এটা নিরসনে কাজ করছি, পাশা পাশি কোথাও আক্রমণ হলে ইন্সট্যান্ট রেস্পন্স, বড় আক্রমণে পসিবিলিটি থাকলে আর্মিকে নিয়ে আসার মতো কাজ গুলো করছি। এবং কারো বাসায় আক্রমণের হুমকি দেওয়া হলে এলাকাভিত্তিক পেট্রোলিং এর ব্যবস্থা করেছি,” রায়হান জানান।

চট্টগ্রামের ছেলে সামিন ইয়াছার সাদ। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানালেন যে ৫ই ও ৬ই অগাস্ট সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ও ভয় দেখানোর ঘটনা ঘটেছে অনেক। তবে তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন হওয়ার পিছনে পুরানো শাসকের হাত দেখছেন। 

“আমরা এখানে যেহেতু শহর অঞ্চলে আছি, এখানে বিচ্ছিন্ন লুটপাট চললেও সংখ্যালঘুদের উপর ওভাবে আক্রমণ হয়নি। যদি হয়নি বলি, ভুল হবে। হয়েছে কিছু জায়গায়, তবে সংখ্যালঘু হিসেবে নয়। তখন আওয়ামী ঘরণার অনেকের বাড়িতে আক্রমণ হয়েছিলো, ওভাবেই হয়েছে। এটা ৫ তারিখের ঘটনা। তবে ৬ তারিখ থেকে মোটামুটি অনেক জায়গায়ই ভয়ভীতি দেখানো ও বিচ্ছিন্ন আক্রমণ হয়েছে। যেহেতু ছাত্রলীগ হোক বা ছাত্রদল, সবই ঘুরেফিরে আশপাশের মানুষ, আমরা বিভিন্ন ফাঁস হওয়া কথপোকথন থেকে জানতে পাই এসব করছিল এলাকায় অবস্থানরত ছাত্রলীগের পাতি মাস্তানেরা,” বললেন সাদ। 

“প্রথমে মন্দিরে মন্দিরে  টহল দেওয়া শুরু হয়েছিলো কারণ দেশের কিছু স্থানে মন্দিরে আক্রমণের খবর এসেছে। আবার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ছাত্রসমাজের কাছে প্রতিনিয়ত খবর দেওয়া হচ্ছিলো কোথাও আক্রমণ হতে পারে নাকি। তখনই সেই অঞ্চলে যত দ্রুত সম্ভব মানুষ ছুটে গিয়েছে,” বললেন সাদ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি সামান্য ঘটনা ছাড়া কিছুই তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটেনি বলে দাবি করলেন সেখানকার যুব স্বেচ্ছাসেবকেরা যাঁরা দিন রাত পুলিশের অনুপস্থিতিতে অঞ্চলের শান্তি রক্ষার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। 

“এখানে এখন পর্যন্ত কোনো রকমের ঝামেলা সৃষ্টি হয়নি,” ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকপাড়া অঞ্চলের বাসিন্দা মিরাজুল হক ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানালেন। “তবে একদল লোক এই সময়কে কাজে লাগিয়ে চার-পাঁচ বছরের পুরানো এক জায়গা (জমি-কেন্দ্রিক বিবাদ)  নিয়ে সমস্যা পুনরাবৃত্তি করতে চায়, আমাদের টিম গিয়ে বাধা দেয়,” জানালেন হক। ইস্ট পোস্ট বাংলা কে তিনি জানান যে জমি কেন্দ্রিক ঝামেলাটা পুরানো তবে সেটা নতুন করে উস্কানোর প্রচেষ্টা চলছিল। এর সাথে তিনি জোর দিয়েই বলেন যে অঞ্চলের মানুষ নিরাপদে রয়েছেন এবং তাঁরা সেখানে পাহারা দিচ্ছেন, যদিও তখনো পুলিশ ফেরেনি থানায়। তাঁর দাবি মানুষ ফোন করেই তাঁদের পাশে পাচ্ছেন। 

“গত পরশু দিনও (৭ই অগাস্ট) রাত ৩ টার সময় কল আসে এক বোনের তার ভাই এর খোজ নিতে। ১৫ মিনিটের মধ্যেই উনার ভাই সুস্থ আছেন এই নিশ্চয়তা দিই এবং সকালেই উনার সাথে যোগাযোগ করেন,” জানান হক। 

তিনি আরও জানান, “আপাতত আমাদের জানমালের রক্ষা সবাই মিলে একসাথেই করার চেষ্টা করছি। এছাড়া প্রতিদিন ট্রাফিক কন্ট্রোল করি, এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের খেয়াল রাখি।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকার পাড়া অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন নর্থ – সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র মোঃ ওয়ালী উল্লাহ। ইস্ট পোস্ট বাংলাকে সাক্ষাৎকার দিতে প্রথমে ইতস্ত বোধ করলেও পরে ওয়ালী উল্লাহ জানান, “প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার পর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোথাও কিছু হয়নি।” 

“রাস্তায়-রাস্তায় টিম করে আমরা ছাত্ররা রয়েছি যাতে কোথাও কোনো বিপদ না হয় সেই চেষ্টাই করছি প্রথম থেকে,” জানালেন ওয়ালী উল্লাহ। তিনি জানালেন যে তাঁদের সাথে অনেক ছাত্ররা যোগ দিয়েছেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে এবং অন্য দিকেও খেয়াল রাখতে। এর সাথেই তাঁরা বিএনসিসি ও স্কাউটের অনেককে পেয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে। তাঁরা হাসিনার পতনের পরে দুটি টিম বানিয়েছেন, অসাম্প্রদায়িক ছাত্র জনতাকে নিয়ে। তাঁরা সংখ্যালঘু নিপীড়ন রোধ করতে প্রস্তুত এবং খেয়াল রাখছেন কোনো মন্দির বা চার্চে যেন হামলা না হতে পারে। তিনি জানান যে তাঁদের ফোন নাম্বার সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে কোনো প্রয়োজনে যে কেউই ফোন দিতে পারেন। 

মোঃ ওয়ালী উল্লাহ ও তাঁর সঙ্গীরা।

পাইকপাড়ার মন্দির এর জমি সংক্রান্ত বিবাদ নিয়ে ওয়ালী উল্লাহও ওয়াকিবহাল। তিনি জানান পুরানো শত্রুতার থেকে একজন মন্দিরের জমি দখল করে রাস্তা চওড়া করার চেষ্টা করছিলেন বলে বিবাদ শুরু হয় আর তিনি ও তাঁর টিম গিয়ে সেখানে তাঁদের বুঝিয়ে শুধু নিরস্তই করেননি, তাঁরা এই রকম প্রয়াস ভবিষ্যতে করলে যে অভিযুক্ত আইনী ফাঁদে ফাঁসবেন সেই কথা বোঝানোর জন্যে সাথে একজন উকিলকেও নিয়ে যান। 

বরিশাল 

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাসিন্দা ও তরুণ স্বেচ্ছাসেবক নাহিয়ান শফিক ইস্ট পোস্ট কে জানান যে তাঁদের অঞ্চলে কোনো সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ঘটেনি। “রাতে সর্বসাধারণের সাহায্য নিয়ে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো পাহারা দিচ্ছি। তবে ভয়ানক কোনো আক্রমণের খবর ৫ তারিখ রাতের পর থেকে পাওয়া যায়নি। এখানে বাংলাদেশের অনেক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মন্দির পাহারা ও শান্তি নিশ্চিত করতে দেখছি,” জানালেন শফিক। 

ঢাকা

রাজধানী ঢাকাতে অবস্থা ৫ই অগাস্ট এর দিন ও তার আগে নানা কারণে খারাপ হয় কারণ ছিল ছাত্র-যুব জনতার সাথে নানা দিকে ছাত্রলীগের দুষ্কৃতীদের সংঘর্ষ হয়। কিন্তু ৫ই অগাস্ট হাসিনা ঢাকা ছেড়ে পালানোর আগেই নানা জায়গার থেকে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে আওয়ামী লীগ কর্মীরা পালিয়ে যান বা কোথাও গা ঢাকা দেন। 

রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর হাতের তালুর মতন চেনেন কাজী মৈত্রী। জানালেন মোহাম্মদপুরের মাঝামাঝি অঞ্চলটিই ওই এলাকার মূল অংশ। এখানে রয়েছে তাজমহল রোড, আওরঙ্গজেব রোড, নূরজাহান রোড, রাজিয়া সুলতানা রোড, সলিমুল্লাহ রোড, শাহজাহান রোড, বাবর রোড, হুমায়ুন রোড, শের শাহ শুড়ি রোড ও আজম রোড। এই অঞ্চলগুলোর সমস্ত বসত ভিটাই হাউজিং সোসাইটির অন্তর্গত, অর্থাৎ তারা সবই গেটেড কমিউনিটি। ফলে এখানে নিরাপত্তা বেশি। 

“এই এলাকার দুটো উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হলো বাঁশবাড়ি দুর্গা মন্দির এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এর ভবন। গত দুই দিনে এই এলাকায় যে ধাওয়া পাল্টা যাওয়া হয়েছে সেটা মুলত ওয়ার্ড কমিশনার এর ভবনের সামনে পিছে আওয়ামী লীগের কারণে। কিন্তু মন্দিরও একই এলাকায় হওয়ার কারণে স্থানীয় হিন্দুরা ভয় পেয়েছে, মোহাম্মদপুরে হিন্দুর সংখ্যা খুবই কম,” জানালেন মৈত্রী। 

সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার ব্যবস্থা যে তাঁরা স্বেচ্ছাসেবকরা দল বেঁধে নিয়মিত করে যাচ্ছেন সে কথা জানান মৈত্রী। “বিশেষ উল্লেখ্য যে এই এলাকা থেকে মন্দির কাছে এ জন্যই উত্তেজনা, পলিটিক্যাল সংঘর্ষকে মানুষ ধর্মীয় অশান্তির আশঙ্কা করেছিল কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। আমরা এখন পর্যন্ত চার রাত পাহারা দিলাম। প্রথম দুই রাত উত্তেজনায় গেলেও পরের দুই রাত খুবই উৎসব আর আনন্দের সাথে সবাই বাসা থেকে বের হয়েছে এবং রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছে। এখন রাতের পাহারা প্রায় পুরোটাই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের হাতে, এরা ইউনিফর্মড অর্থাৎ সাদা পাঞ্জাবি, টুপি, আইডি কার্ড হাতে লাঠি,” মৈত্রী জানান। 

পাহারা নিয়ে বিস্তারিত জানাতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবক মৈত্রী জানালেন যে মোহাম্মদপুরে আছে মোহাম্মদী ইয়ুথ ক্লাব, স্থানীয় কল্যাণ সমিতির সিকিউরিটি গার্ড, এদের সাথে এসে জুটেছে আশেপাশের তিনটি মাদ্রাসার ছাত্ররা। “অর্গানাইজড গ্রূপের মধ্যে আছে ফায়ার ভলান্টিয়ার, হ্যাম রেডিও গ্রুপ, স্কাউটের দল (এরা রাতে পাহারা দেয় না),” জানালেন তিনি। 

“মোহাম্মদপুর এলাকায় সংখ্যালঘু কম, যারা আছে তারা ভালো আছে, তবে প্রান্তিক অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের সমস্যা অবশ্যই হচ্ছে, যেমন পঞ্চগড়। ঢাকা শহরে হিন্দুদের ক্ষতি কেউ করবে না, চার্চ পোড়াবে না”

তাঁর মতে মোহাম্মদপুর সম্পূর্ণ ভাবে স্বাভাবিক আছে। বছিলা এলাকা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। “মোহাম্মদপুর এলাকায় সংখ্যালঘু কম, যারা আছে তারা ভালো আছে, তবে প্রান্তিক অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের সমস্যা অবশ্যই হচ্ছে, যেমন পঞ্চগড়। ঢাকা শহরে হিন্দুদের ক্ষতি কেউ করবে না, চার্চ পোড়াবে না,” বললেন মৈত্রী। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোঃ আসিফুজ্জামান রাজধানীর রামপুরা, খিলগাঁও ও বনশ্রী অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করছেন। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানান যে তাঁর অঞ্চলে যে অশান্তি ৫ই অগাস্ট শুরু হয় তা হলো মূলত থানা আক্রমণ ও লুটপাটের ঘটনা। তিনি জানান অঞ্চলে একটি মন্দির সেই সময় আক্রান্ত হয় যা ছিল থানার পাশেই এবং তার উপর আক্রমণ থানার উপর আক্রমণেরই একটি অংশ। তবে আসিফুজ্জামান দাবি করেন যে তাঁরা, স্বেচ্ছাসেবকেরা এই ঘটনার পর থেকে টহলদারি বাড়ান ও সামগ্রিক অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের কাজ করেন।

অঞ্চলে থানা হামলার সময়ে তিনি ২২ জনের একটি দলকে সেখানে পাঠান বলে জানান আসিফুজ্জামান, এবং তারপরে অবস্থা আয়ত্তে আসে। সেই সময়ে অঞ্চলে মন্দির ও থানার কাছে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের দোকানেই ভাঙচুর হয় বলে তিনি জানান। 

“সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যদি আমি বলি, তাহলে এটা একটা প্রোপাগান্ডার অংশ বাংলাদেশে ডিভাইড এন্ড রুল (ভাগ করো এবং শাসন করো) প্রয়োগ করার জন্যে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের যাঁরা অংশ ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ এই সব জায়গায় আঘাত করছেন, এটা বাংলাদেশের জনগণ মনে করে যে এটা আওয়ামী লীগের একটা প্রোপাগান্ডা। তা ছাড়া বেশির ভাগ গুজব, ফেক নিউজ (ভুয়ো খবর) ছড়ানো হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে ছবি এডিট করে, কিছু ক্ষেত্রে পুরানো ঘটনার ভিডিও কে এখনকার বলে চালিয়ে,” জানালেন জলবায়ু এবং বন্যা বিশেষজ্ঞ রিয়াসাত আমিন, যিনি স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করছেন ঢাকার খিলগাঁও অঞ্চলে।

“কিছু ঘটনা যে ঘটছে না তা নয়, কিন্তু সেগুলো ঘটছে ভাগ করো ও শাসন করো নীতির জায়গার থেকে, এটা প্রমাণ করতে যে আওয়ামী লীগের শাসন না থাকলে সংখ্যালঘুরা ভালো থাকবে না”

আমিন জানান যে তিনি নিজে ‘সেভ দ্যা টেম্পল’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী দলের সদস্য যাঁরা যখনই কোনো মন্দিরে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলেই বা কেউ ফোন করলেই তাঁরা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে ছুটে যাচ্ছেন। “কিছু ঘটনা যে ঘটছে না তা নয়, কিন্তু সেগুলো ঘটছে ভাগ করো ও শাসন করো নীতির জায়গার থেকে, এটা প্রমাণ করতে যে আওয়ামী লীগের শাসন না থাকলে সংখ্যালঘুরা ভালো থাকবে না,” বললেন আমিন। 

ঢাকার মিরপুরের সাকির নিজে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সাথে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থলগুলো পাহারা দিচ্ছেন এবং ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানালেন যে তাঁদের ওখানে কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি দাবি করেন যে মিরপুরে মানুষ নিরাপদে আছেন। 

মিরপুরেরই আর এক যুবক ফাহিম বলেন, “সংখ্যালঘুদের সাহায্যের জন্যে সচেতন ছাত্রজনতা মাঠে আছে। দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে যাতে পরিস্থিতি অনূকুলে থাকে। কেউ চাইলেও শিক্ষার্থীরা এই সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হতে দিবে না। এবং ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কিছু ধ্বংসাযজ্ঞের কিছু ছবি বা ভিডিও দুর্বৃত্তরা  ছড়িয়ে যাচ্ছে, যেগুলো গুজব, একেবারে হচ্ছে না বললে ভুল হবে, তবে এলাকার লোকজন খুবই সচেতন।”

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন প্রতিহত করার প্রচেষ্টা
মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির প্রহরায় স্বেচ্ছাসেবকেরা। ছবি সত্ত্ব: ফাহিম

কী ভাবে তাঁরা এই সব ঘটনার মোকাবিলা করছেন জানতে চাইলে ফাহিম বলেন, “আমরা ছাত্ররা চেষ্টা করছি এলাকাভিত্তিক কমিটি গঠন করে কাজ করে যাওয়ার! নিরাপত্তা নিশ্চয়ন থেকে শুরু করে যেসকল জায়গাগুলিতে আপাতত কোন ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে তা স্বাভাবিক করে আনার।”

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন প্রতিহত করার প্রচেষ্টা
আমরা সাভারবাসী দলের সদস্যরা মন্দির রক্ষায় নিয়োজিত

সাভারে আবার আমরা সাভারবাসী দল একযোগে শুরুর থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্যে সজাগ থেকেছে। এই দলের তরফ থেকে জানানো হলো, “৫ই অগাস্ট কিছু সমস্যা হয়েছিল, তবে সাভারই একমাত্র জায়গা, যেখানে সাম্প্রদায়িক কোন অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটেনি। আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাইদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সর্বোচ্চ কাজ করেছি শুরু থেকে।”

“দুষ্কৃতিকারীরা এখনো যায়নি বা এরা আছে। এরা কোনো ধর্মের না, এরা যেমন মন্দির ভাঙছে তেমনি মাজার, ভাষ্কর্য, মুরাল ভাঙছে। এরা খোদার পথভোলা নাদান মানুষ। শিক্ষিত সমাজ এদের ধিক্কার জানাচ্ছে”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভীর ইমতিয়াজ অতুল জানালেন, “ঢাকায় এখন পর্যন্ত কোনো মন্দির ভাঙচুরের খবর পাইনি। এখানে সবাই আমরা যে যেখানেই সম্ভব মন্দির পাহারা দিচ্ছি। দুষ্কৃতিকারীরা এখনো যায়নি বা এরা আছে। এরা কোনো ধর্মের না, এরা যেমন মন্দির ভাঙছে তেমনি মাজার, ভাষ্কর্য, মুরাল ভাঙছে। এরা খোদার পথভোলা নাদান মানুষ। শিক্ষিত সমাজ এদের ধিক্কার জানাচ্ছে। ঢাকার বাইরে চিত্রটা একটু ভিন্ন, সেখানে কিছু মন্দিরে হামলার ব্যাপারটা আমরা শুনছি। তবে সেনাবাহিনীর যত দ্রুত সম্ভব সকল এলাকা কভার করছে আর এই দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার করছে।”

বাজার প্রহরায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভীর ইমতিয়াজ অতুল ও তাঁর সঙ্গীরা

হবিগঞ্জ 

হবিগঞ্জের প্রাক্সিস হবিগঞ্জ নামক আইইএলটিএস সংস্থার ডিরেক্টর হোসাইন আহমেদ সাগর জানান যে সেখানে কোনো ধরণের সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। এর সাথে সাথে সাগর জানান যে তাঁরা নিয়ম করে অঞ্চলে পাহারা দিচ্ছেন ও রাতে সংখ্যালঘুদের উপসনালয়ে পাহারা দিচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এর ফলে কোনো ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। “আমরা আছি আমাদের ভাইদের পাহারায়। আগে আমাদের উপর আঘাত আসবে। তারপর ওদের,” বললেন সাগর। 

হবিগঞ্জেরই সৌরভ আহমেদ ইস্ট পোস্ট কে জানালেন, “সংখ্যালঘুদের উপর কোনো প্রকার হামলা হয়নি। হামলা হয়েছে শুধুমাত্র স্থানীয় এমপি এবং মেয়রের বাসায়।” আক্রমণের ঘটনা কে নস্যাৎ করে আহমেদ জানান যে সেখানে ছাত্ররা সজাগ রয়েছেন।  “রাত জেগে ছাত্ররা মন্দির পাহারা দিয়েছে,” বললেন তিনি। 

গাইবান্ধা 

“আমাদের জেলায় বর্তমানে খুবই শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে সবাই মিলেমিশে আছে কারো মাঝে কোনো দাঙ্গা বা ক্ষোভ নেই! দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেলেও আমাদের জেলায় এখন পর্যন্ত তেমন কোনো খবর পাওয়া যায় নি,” উত্তরবঙ্গের গাইবান্ধার বাসিন্দা ফারহান সাদিক ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানালেন। 

তাঁর বক্তব্য গাইবান্ধার নানা অঞ্চলে ছাত্ররা দল বানিয়ে মানুষের সাথে থাকার, অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করছেন ও কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা যে ঘটেছে তার কারণ পুরোদস্তুর পুলিশ ও প্রশাসনের অনুপস্থিতি। তবে তিনি মনে করেন বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নাই। 

আইনশৃঙ্খলার সমস্যা

অনেকের মত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন বা হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা অনেক জায়গায় ৫ ও ৬ই অগাস্ট ঘটলেও তারপরে স্তিমিত হয়ে যায় ছাত্রদের পাহারা আর সেনাবাহিনীর টহলের কারণে। সেনাবাহিনী এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় কোনো ভাবেই সংখ্যালঘুদের উপর দুষ্কৃতী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি আঘাত করতে সক্ষম হয়নি। 

তবে যে ভাবে বিএইচবিসিইউসি, ও তার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সদস্য-সমর্থকেরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে ঢাকার কেন্দ্রে আন্দোলন করছেন, এর পিছনে কেউ কেউ গভীর অভিসন্ধি দেখছেন। কারণ চট্টগ্রাম ও উত্তর বঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটলেও তার পিছনে অঞ্চলের মানুষের অভিযোগের তীর সদ্য ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগের দিকে। 

এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির ও জামাতের জঙ্গীদের বিরুদ্ধেও নানা ধরণের সাম্প্রদায়িক অশান্তিতে মদদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি এই অভিযোগের ভিত্তিতে দুই জন দলীয় নেতা কে বহিস্কার করেছে।

অনেকের মতে শাহবাগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন বিরোধী ধর্ণা প্রদর্শনের পিছনে প্রতিবেশী ভারতের হাত আছে যেহেতু অনেক আওয়ামী লীগের সংখ্যালঘু সদস্য সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপির স্লোগান তুলে ভারতের শাসক দলের একটি অংশ কে আকর্ষিত করার প্রচেষ্টা করছেন। 

তবে চট্টগ্রামে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার সাথে সাথে যে বিষয়টি খুব চিন্তাজনক ভাবে বৃদ্ধি পায় তা হলো চাঁদাবাজির ঘটনা। এর সাথে মূলত সদ্য প্রাক্তন শাসক দল আওয়ামী লীগের যোগাযোগ যেমন পাওয়া যাচ্ছে তেমনি পাওয়া যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী আসনে বসে থাকা বিএনপির কর্মীদের। 

“ওরা (পুরানো শাসকদলের লোকেরা) আসলে ইন্ধন দিচ্ছে। ইন্ধনের মাধ্যমে বিভিন্ন লুটতরাজ করাচ্ছে। নিজেরা করছে না। চট্টগ্রামের কিছু স্থানে চাঁদাবাজির ঘটনায় ওদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কয়েকজন ডাকাতকে ধরা হয়েছিলো ওদের মধ্যে অনেক ছাত্রলীগ কর্মী পাওয়া গেছে,” জানালেন রায়হান।

তিনি জানান যে পুলিশের অনুপস্থিতিতে আইন শৃঙ্খলা চূড়ান্ত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার ফলে অনেক লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছে। “আইন শৃঙ্খলা না থাকায় অনেক স্থানে লুটতরাজ, অরাজকতা হয়েছে এটা খুব সত্য। কিন্তু এখন এলাকাভিত্তিক কমিটিগুলো তৈরি করা হয়েছে, ছাত্রদের পাশাপাশি এলাকার যুবকেরা আমাদেরকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সাহায্য করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে ট্রাফিক কন্ট্রোলের কাজগুলোর পাশাপাশি চাঁদাবাজি বন্ধ, আক্রমণ প্রতিহত করা নিয়েও তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছে,” জানান তিনি। 

ডাকাতি আর চাঁদাবাজির ঘটনা চট্টগ্রামে কী ভাবে বাড়ছে সেটা জানালেন সাদও। “বিগত কিছুদিনে যারা ডাকাতির উদ্দেশ্যে নেমেছে, তাদের কাছে এমন ভয়াবহ দেশীয় অস্ত্র রয়েছে, যার সামনে সাধারণ মানুষের দাঁড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে,” বললেন সাদ। তিনি জানান ৯ই অগাস্ট অবধিও প্রতি দিন একটি বা দুটি জায়গায় ডাকাতির খবর আসছে আবার মানুষের হাতে ধরাও পড়ছে ডাকাতেরা। 

“যেহেতু বাজার অঞ্চলে এসব চলছে কমবেশি, আমাদেরকে কেউ অভিযোগ দিলেই সবাই মিলে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসছি। তবে আমাদের হাতে তো আর ওভাবে কোনো অস্ত্র নেই, তাই অবশ্যই বেশিদিন এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা আমাদের সম্ভব হয়ে উঠবে না,” বললেন সাদ। 

“৫ তারিখের পরের কথা বলতে গেলে ৫ তারিখের কথা দিয়েই শুরু করতে হবে। একদিকে যখন বেশিরভাগই বিজয় উল্লাসে ব্যস্ত ছিলাম তখন কিছু জনতা, বিশেষ করে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী শিক্ষাবঞ্চিতরাই, থানা সহ বিভিন্ন স্থাপনা লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ৬ আগষ্ট থেকে আমরা, শিক্ষার্থীরা, নিজ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা সংস্কারের কাজে নামি। এর মধ্যে থানা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল ও লুটপাট হয়েছিল। তাই আমরা এই থানার সকল সম্পদ ফেরানোর উদ্দেশ্যে মাঠে নামি,” ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানান বরিশালের শফিক। 

তিনি আরও জানান যে তিনি এবং ১০০-র ও বেশি ছাত্র যুবরা থানার লুন্ঠিত মালপত্র উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন।

“৭ আগষ্টের মধ্যেই থানাসহ বাকি স্থাপনাগুলো পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। রাস্তায় আমরা ট্রাফিক সামলাচ্ছি, প্রতিটা লোক আমাদের ভালোবাসা দিচ্ছে আমরা মুগ্ধ। সবাই আমাদের সাহায্য করছে, তাই আমাদের যানজট নিরসনের কাজ খুব ভালোভাবে করতে পারছি। যানজট নিরসনের পাশাপাশি আমরা ফুটপাত ব্যবহারের প্রতি পথচারীদের উদ্বুদ্ধ করছি, এবং পার্কিং নিয়েও কাজ করছি,” জানান শফিক। 

৫ অগাস্ট থেকে কোনো সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা গৌরনদী অঞ্চলে ঘটেনি বলে জানান শফিক। কিন্তু শফিকের উদ্বেগ হলো বাংলাদেশের পুলিশ ধর্মঘটে যাওয়ার পর থেকে নিরন্তর বৃদ্ধি পাওয়া ডাকাতির ঘটনাগুলো। 

“গত দুই দিনে ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে, বিশেষ করে ঢাকাতে,” তিনি জানান ও যোগ করেন, “তবে গত রাত থেকে যে পরিমাণ লোক নিজ নিজ এলাকা পাহারা দিচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর যে তৎপরতা তাতে করে খুব দ্রুতই এই সমস্যা কমে আসবে বলে আশা করছি।”

তবে ছাত্ররা যে শুধুই রাস্তায় নেমে যান চলাচল সামলাচ্ছেন না, শুধুই নানা অঞ্চলে পাহারা দিচ্ছেন না, তাঁরা কালোবাজারিও রুখছেন। 

“আমাদের বর্তমান কার্যক্রম বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণ, শহর ও মফস্বল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা এবং নতুন সরকারকে যতটা সম্ভব সাহায্য করা একটি সুন্দর ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়তে,” প্রতিবেদক কে জানান শফিক। 

মোহাম্মদপুরের কাছে অবস্থিত বিহারি ক্যাম্প বা স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানী ক্যাম্প থেকে সমাজ-বিরোধী উর্দুভাষীরা ছুরি নিয়ে ডাকাতি করছে বলে জানান মৈত্রী। উনি জানান অনেক জায়গায় এরকম স্থানীয় ভাবে বানানো ধারালো অস্ত্র নিয়ে বিহারিরা লুটপাট করতে গিয়ে জনগণের হাতে ধরা পড়েছেন। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অতুল কিন্তু চাঁদাবাজির জন্যে বিএনপির দিকেও আঙ্গুল তুললেন। “বিরোধী দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। শুরুতেই বলেছি যে আমরা চাঁদাবাজিও দমন করছি। এখানে মূলত চাঁদাবাজ গুলো হচ্ছে নতুন। মানে বিরোধী দলের লোকেরা। এরা ভাবছে, যে এরাই এখন ক্ষমতায় চলে এসেছে,” বললেন অতুল। তাহলে সাধারণ মানুষ কী ভাবছেন জানতে চাওয়ায় বললেন, “শিক্ষিত সমাজ বলুন আর সাধারণ জনগণ বলুন, সবাই এখন চায় নতুন কাউকে। আওয়ামী লীগকেও যেমন আমরা চাই না, তেমনি বিএনপি/জামাত কাউকেই চাইনা। এরা সব একই—১৫ বছর একজন শোষণ করে গিয়েছে, আর আরেকজন ১৫ বছর ধরে ক্ষুদার্থ। বুঝতেই পারছেন, এরা এলে দেশটা গিলে খাবে। আমরা কেউই চাইনা তা,” বললেন তিনি। 

শেষ পরিস্থিতি 

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন হওয়ার অভিযোগ উঠলেও, বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবকের মতে সরকার গঠনের পরে পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হচ্ছে ও চাপে পড়ে পুলিশকে পুরানো দলদাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে নিজ ভূমিকা পালন করতে হবে। ছাত্রদের দল যেমন সাম্প্রদায়িক আক্রমণগুলো প্রতিহত করার চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছেন তেমনি রাস্তা পরিষ্কার, দেওয়াল পরিষ্কার, ট্রাফিক চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও কালোবাজারি দমনেও জুটেছেন। 

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন, হিন্দু নির্যাতনের কারণে হাজার হাজার সংখ্যালঘুর চোখে, যাঁদের ভীতি কে ব্যবহার করে হাসিনা তাঁদের নিজের বশে ১৫-১৬ বছর ধরে রাখতে সক্ষম ছিলেন বলেই জানালেন ছাত্রদের বেশির ভাগ, এখনও সংশয় দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। যদিও দেশের রাজনৈতিক পালা বদলের মাধ্যমে মার্কিন বান্ধব ইউনুস কে ব্যবহার করে চীন বিরোধী যুদ্ধ ঘাঁটি গড়তে ওয়াশিংটন ও পশ্চিমা শক্তি এবার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কে খর্ব করতে পারে বলে দেশের বাম ও গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তি চিন্তিত, তবুও নতুন বাংলাদেশের উপর বাজি রাখছেন সেখানকার যুবরা। তাঁরা বলছেন যে স্বাধীনতা তাঁরা আদায় করেছেন রক্তের বিনিময়ে তা তাঁরা হারাতে দেবেন না। 

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন, হিন্দু নিপীড়ন নিয়ে নানা সংশয় টিকিয়ে রেখে যে নব্য বাংলাদেশ তার যাত্রা শুরু করেছে সে কি এই যুবদের আশা ও ভরসা কে রক্ষা করতে পারবে?

Leave a comment
scroll to top