যাদবপুরে ব়্যাগিং কাণ্ডে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় নেট দুনিয়া। সরগরম খবরের চ্যানেলের টক শো। এই টক শো কে কেন্দ্র করেই বিতর্কের সূত্রপাত। গত ১৭ই আগস্ট, যাদবপুরে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে টক শো-র আয়োজন করে নামজাদা সংবাদমাধ্যম জ়ি ২৪ ঘন্টা যা হোস্ট করেন সংবাদসংস্থার সম্পাদিকা মৌপিয়া নন্দী। কিন্তু সময় এগোতেই জল গড়ায় অন্যদিকে। নেটিজেনদের অভিযোগ, উক্ত টক শো তে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে একতরফাভাবেই ছাত্রদের আক্রমণ করে গিয়েছেন মৌপিয়া। নেটিজেন দের অনেকেরই দাবি অতিথিদের ডেকে এনে তাদের কথা বলতে না দিয়ে, তাদের উপর চিৎকার চেচামেচি করে অপমান করা হয়। “এটা ব়্যাগিং মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ” বলছে একাংশের নেটিজেন সহ বুদ্ধিজীবী এবং প্রতিবাদী ছাত্র ছাত্রীরা। কেউকেউ তাকে রিপাবলিক টিভির সম্পাদক অর্ণব গোস্বামীর সস্তার সংস্করণ বলে দাবি করেছেন, কেউ বলেছেন “দোসর”।
কিন্তু গোল বাঁধলো অন্যদিকে। মৌপিয়া নন্দী-র এই সাংবাদিকতার ধরণ নিয়ে হাজার সমালোচনা নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লেও তার সাথেই ছড়ালো এক ‘বিশেষ’ সমালোচনা। সংবাদমাধ্যম কর্মী হিসেবে নিজেকে দাবি করা সৌভিক দে নামে মৌপিয়ার একজন প্রাক্তন সহকর্মী লিখলেন, “ভৌপ্রিয়া এখন বিরাট হনু…”। তার পোস্টে সৌভিক লিখেছেন, “সে প্রায় বছর চোদ্দ-পনেরো আগের কথা। পোদ্দার কোর্টে এক নিউজ চ্যানেল। ভৌপ্রিয়া একজন পিওন দাদাকে ঝালমুড়ি আনতে দিয়েছে। শুধু তো ভৌপ্রিয়া নয়।আরো অনেকের খাবার অর্ডার নিয়ে খাবার আনতে গেছেন ওই পিওন দাদা। বেশ কিছুক্ষণ পর সকলের খাবার নিয়ে ফিরলেন। ভৌপ্রিয়া তার মুড়ি খেতে গিয়ে দেখলো মুড়ি মিইয়ে গেছে। এমত পরিস্থিতিতে অন্য কে কী করবেন জানা নেই। কিন্তু ভৌপ্রিয়া প্রথমে যাচ্ছেতাই অপমান করলো ওই দাদাকে।তারপর মুড়ির ঠোঙা থেকে মুড়ি সরাসরি ঢেলে দিলো ওই পিওন দাদার মাথায়।”
কিন্তু প্রশ্ন এই ‘ভৌপ্রিয়া’ কে? এর উত্তরের জন্য খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি নেটনিবাসীদের। সৌভিকের এই পোস্টের স্ক্রিনশট পোস্ট করলেন স্বয়ং মৌপিয়া নন্দী। কিন্তু সেখানেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না। স্ক্রিনশটে সৌভিকের নাম ঢেকে দিলেও তার একটি পারিবারিক কলহের ভিডিও শেয়ার করলেন ওই পোস্টেই। সাথে লিখলেন, “যিনি এত নীতিকথা কপচাচ্ছিলেন আমায় নিয়ে তিনি নিজের বাবার সঙ্গে কী দারুণ আচরণ করেন দেখুন। audio mute করলাম না ইচ্ছে করেই। এবার বুঝছেন তো কোন অবস্থায় আমাকে মাথায় মুড়ি ঢালতে আর আমার বাবাকে বামপন্থী দেখেন। ফালতু কেঁচো কেন খুঁড়তে যাও ভাই?” যথারীতি সৌভিকের পোস্টের ‘ভৌপ্রিয়া’ যে তিনিই তাতে নিজেই ছাড়পত্র দিলেন মৌপিয়া নন্দী। এসব অভিযোগকে গল্প বলে দাবি করেছেন সঞ্চালিকা।
কিন্তু তাতেও ছাড় মিলল কী? ঘটনাচক্রে এবার সমালোচনা শুরু হয়েছে মৌপিয়ার আচরণ নিয়ে। কেউ বলছেন এটা তার কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ, তো কেউ বলছেন এ চূড়ান্ত অপেশাদার আচরণ কিন্তু যে কথাটা একযোগে সকলেই বলছেন তা হল, যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না। এই দৌড়ে বাকী নেই সাধারণ মানুষ থেকে বিখ্যাত সাংবাদিকও। ঘটনা প্রসঙ্গে সৌভিকের সাথে কথা হয়েছে ইস্ট পোস্ট বাংলার প্রতিনিধির। এ বিষয়ে সৌভিকের বক্তব্য, “আমি জ্ঞানতই পোস্টে মৌপিয়ার নাম ব্যবহার করিনি, কারণ ব্যাপারটা বেআইনি।” মৌপিয়ার পোস্ট সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি চাইলে এখনও আমার আইনজীবীর সাহায্য নিয়ে তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতেই পারি, কিন্তু আমি তা করবো না…আসলে মৌপিয়া এতই সমালোচনার মুখে পড়ছেন যে তিনি কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন এবং বেড়িয়ে আসার পথ পাচ্ছেন না; তাই তিনি এইসব করছেন।” তিনি আরও বলেছেন, “আমার বড় হওয়াটা বামপন্থী মতাদর্শের আওতায়। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময় দেখেছি মৌপিয়া সিপিএমের হয়ে ভীষণ তৎপর ছিলেন। এবং একই রকম তৎপর তিনি এখনও তবে বিজেপি-আরএসএস এর হয়ে। কর্পোরেট মিডিয়া হাউসগুলোর পক্ষ থাকে ঠিকই কিন্তু সব কিছুরই একটা লিমিট থাকে।”
ভিডিও প্রসঙ্গে সৌভিক ইস্ট পোস্ট বাংলাকে জানিয়েছেন যে ওই ভিডিওটি লকডাউনের সময়কার ভিডিও যখন তিনি অ্যালকোহলের অ্যাডিকশন থেকে বেড়িয়ে আসার পর্যায়ে রয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন যে তিনি এখন আর অ্যাডিকটেড নন বটে তবে সমস্যা পুরোপুরি কাটেনি। গতকালের ঘটনার ফলস্বরূপ এবং কাজের ভীষণ চাপে কার্যত তিনি ওষুধ খেয়ে রয়েছেন যাতে তার নেশার অবলম্বনের প্রয়োজন না পড়ে।
মৌপিয়ার করা পোস্টের আরও একটি পাল্টা পোস্ট করেছেন সৌভিক। তিনি লিখেছেন, “ওই ভিডিও পোস্ট করে ভৌপ্রিয়া নিজেকে জাস্টিফাই করার একটা হাস্যকর এবং ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। সে ভৌপ্রিয়া নিজেকে ইনোসেন্ট, নির্দোষ যাই প্রমান করার চেষ্টা করুক না কেন, পিওন দাদার মাথায় মুড়ি ঢালা তাতে জাস্টিফাই করা যায় না বলেই আমার মনে হয়।নিয়মিত পিওন দাদা/ভাইদের সঙ্গে পদমর্যাদার জেরে অকথ্য দুর্ব্যবহার করাটাও বেশ পীড়াদায়ক।”
এই পোস্টের বিভিন্ন সূত্র ধরে আরও কিছু মন্তব্য এসেছে। সাংবাদিক অতনু সিংহ মন্তব্য করেছেন, “ভৌপিয়া তার অফিসের অধস্তনদের কী ভাষায় কথা বলে, তার ভিডিও বাইরে আনা দরকার৷ খ-এর ছেলে ছাড়া কথা বলে না ভৌপিয়া তেলাপিয়া নন্দী।”
প্রসঙ্গত, মৌপিয়ার আর একজন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সহকর্মী ইস্ট পোস্ট বাংলাকে বলেছেন যে কোলকাতার মিডিয়া জগৎ যেহেতু বেশ ছোট্ট, তাই ইতিউতি বাতাসে ভেসে বেড়ায় নিজের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস থেকেই নাকি বড় মাপের সংবাদকর্মীদের চ্যানেল থেকে অপসারণের মূলেও নাকি এই ‘দুঁদে অ্যাঙ্কর’।
কারো নাম না করে বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং লেখক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য তার ফেসবুক ওয়ালে একটি লম্বা পোস্টে লিখেছেন “টিভিতে বিতর্কের নামে কিছু সাংবাদিক নির্লজ্জ ভাবে ছাত্রদের যেভাবে দাবড়ানি দিয়ে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করছেন তা স্পষ্টতই র্যাগিং ও বুলিং এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে এই সাংবাদিকরা তাঁদের সহকর্মীদের অনেককেই এভাবেই র্যাগিং ও বুলিং করে থাকেন। এটা তাঁদের স্বভাব, যা এখন ছাত্রছাত্রীদের ওপর প্রযুক্ত হচ্ছে।”
তিনি আরো লেখেন “নিজেকে সর্বেসর্বা ভেবে যে তন্দ্রাহরণী ছাত্রছাত্রীদের দাবড়ানি দিচ্ছেন ও মর্যালিটি শেখাচ্ছেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করুন তাঁর সাহস হয়েছে কিনা রাজ্যের বিরোধী দলনেতাকে এভাবে জিজ্ঞেস করারঃ আপনি কেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বার বার ‘বেগম’, ‘খালা’, ‘আপু’ বলে সম্বোধন করলেন? ওদিকে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা একটি সামাজিক সমস্যা। ঠিক কথা। কিন্তু সমাজিক সমস্যা জানার পরও ভোটার নিরাপত্তার স্বার্থে উনি কেন একাধীক দফায় অধিকতর বাহিনী দিয়ে নির্বাচন করানোর প্রস্তাব দিলেন না, সেই প্রশ্ন কি ওই সাংবাদিক মুখ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছেন? একথা সবারই জানা যে মুখ্যমন্ত্রী অবধি পৌঁছনোর রাস্তা তাঁর জানা আছে।”
কারো নাম না করে সাংবাদিক দীপাঞ্জন সিনহা ফেসবুকে লিখেছেন “সাংবাদিকতার আড়ালে প্রোপাগান্ডা যন্ত্রের চেয়ে বড় অপশক্তি আর নেই, যাদের একমাত্র কাজ রক্তপিপাসু জনতা তৈরি করা।”
বহু সাংবাদিকের পোস্টে কারো নাম উল্লেখ না থাকলেও বা “তেলাপিয়া” “গৌপ্রিয়া” “ভৌপ্রিয়ার আড়ালে আসলে মৌপিয়ার দিকেই আঙুল উঠছে কিনা সেই প্রশ্ন থাকছেই। মৌপিয়া পোস্ট করেছিলেন “1st home এ শাসন ও শিক্ষা থাকলে 2nd home এ মদ খাওয়ার অধিকার ঘুচে যেত।” এর পরেই মূলধারার সংবাদ কলম লেখক ফেসবুক পোস্টে লিখেন, “সেকেন্ড হোমে নিয়মানুবর্তীতা থাকলে ফাস্ট হোমে তেলাপিয়াকে বেহেড মাতাল হয়ে ফিরতে হত না।” যদিও এক জাতীয় স্তরের সিপিআই এমএল নেতার ব্যাক্তিগত অনুরোধে কলম লেখক এই পোস্টটা মুছে দেন। কারণ তার মত অনুযায়ী সঞ্চালিত যে ভাবে গোটা যাদবপুরের ছাত্রদের মাতাল প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, তার বিরোধিতা রাজনৈতিক ভাবে করা উচিৎ, ব্যক্তিগত ভাবে নয়।
সঞ্চালিকা তার এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করে ছেন যে তিনি আসলে অভিজাতদের মৌচাকে ঢিল মেরেছেন। এই মর্মে তিনি তাঁর পোস্টে লিখেছেন, “আমি জানি মৌচাকে ঢিল পড়েছে।
সত্যিই তো JU এ যা যা হয় তা মিডিয়া জানত না? আলবত জানত। কিন্তু এলিট গ্রুপের হাতে তামাক খেয়ে মিডিয়ার কিছু হর্তাকর্তা এইসব প্রতিষ্ঠানের নেতিবাচক দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকত। জুনিয়র সহকর্মীর আনা তথ্য ডাস্টবিনে চলে যেত সন্ধেয় কোনো এলিটের সান্নিধ্যে সিঙ্গল মল্ট আর কামু কাফকা আওড়ানোর সমীকরণে।”
যারা মৌপিয়ার উপর ন্যায্যতই ক্ষুদ্ধ তাদের বক্তব্য, মৌপিয়া তার কমেন্ট বাক্স সর্বসাধারণের জন্য অফ রাখছেন আবার তাদের নিয়েই কার্যত খাপ বসাচ্ছেন। এ অন্যায়।
তার বিরুদ্ধে ওঠা, কর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার এবং হাউস পলিটিক্স করে কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে মৌপিয়া নন্দি ইস্ট পোস্ট বাংলাকে বলেছেন “মাতাল অপোগন্ডদের কথায় বিশ্বাস করবেন কি না সেটা আপনার চয়েস. আমি পরোয়া করিনা, ওতে আরো কিছু মশলা যুক্ত করে নিতে পারেন।”