Close

লুন্ঠনে জর্জরিত আরব মধ্যমণি ইয়েমেন- দ্য ক্রেডেলের তদন্ত রিপোর্ট

যুদ্ধের জন্য লুঠ না লুঠের স্বার্থে যুদ্ধ? কারা লুঠ করছে ইয়েমেনের প্রাকৃতিক সম্পদ? যুদ্ধে যুদ্ধে বিপর্যস্ত ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ।

মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন বসতি আর আরব বিশ্বের সবচেয়ে গরীব দেশ ইয়েমেন। গৃহযুদ্ধে দেশটি পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইয়েমেনের বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে, যা কেবল অস্ত্রের হানাহানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দশকের পর দশক ধরে লুঠ হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ।

দ্য ক্র্যাডেলে প্রকাশিত করিম শামির একটি লেখায় উঠে আসছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে সৌদি আরব ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তা যে কেবল দেশ জুড়ে মানবসম্পদ হানিই ঘটিয়েছে এমনটা নয়। ইয়েমেন হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক লুটেরাদের আড্ডাখানা। যদিও রিয়াধ ও সানার মধ্যে সরাসরি শান্তি বৈঠক চলার কারণে আট বছর ব্যাপী যুদ্ধের তীব্রতা কিছুটা কমেছে, তবুও দেশি বিদেশী শক্তির দ্বারা সম্পদলুন্ঠন এখনও অপ্রতিরোধ্য।

ইয়েমেনের তিনটি সক্রিয় তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনকারী কেন্দ্র এখন বিভিন্ন বিদেশী আগ্রাসী শক্তির হাতে, যারা ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোয়ালিশনকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। মারিব, যা একটি অত্যন্ত সম্পদপুষ্ট অঞ্চল। যেখানে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উভয়ই উত্তোলিত হয়। তা বর্তমানে পরোক্ষভাবে সৌদির আরবের অধীনে।
দক্ষিণ অঞ্চলের শাবওয়া তার তেল উত্তোলক কেন্দ্র এবং পাইপলাইন সহ গোটাটাই আরব আমিরাতের মদতপুষ্ট সাদার্ন ট্রান্জিশনাল কাউন্সিলের (এসটিসি) অধীন। দক্ষিণের হাথরামাউথ, যা মূলতঃ তার তেলের খনিগুলির জন্য বিশ্ববিখ্যাত। এটি এখন কার্যত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের অধীনে, তখনই আবার বন্দরগুলো মূলত এসটিসি-র অধীনে। ইয়েমেনের কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থান ও অগুনতি বন্দর এই চুরির মাল তৎপরতা ও নিপুণতার সাথে পাচার করায় সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বলে শামি-র মত।


এই যুদ্ধাবস্থার পেছনে ভূরাজনৈতিক কারণ কী ছিল?

আনসারাল্লার বিরুদ্ধে হওয়া ‘২১শে সেপ্টেম্বর বিপ্লব’-এর পর ২০১৫ সালে ইয়েমেনের ক্ষমতায় আসে সৌদি মদতপুষ্ট আবদারাবু মনসুর হাদি। আজ আট বছর পর হাদি আর ক্ষমতায় নেই। ২০২২ এর এপ্রিলে তাকে বলপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করে সৌদি এবং ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় সৌদি মদতপুষ্ট প্রেসিডেন্সিয়াল লিডারশিপ কাউন্সিল (পিএলসি)। এই চলমান যুদ্ধের ফলে ইয়েমেনের পেট্রো সেক্টরে ৪৫০ কোটি ডলার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্রেফ ২০২২ সলেও তেল লুঠ হয়েছে প্রায় ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার। এর পরেও যুদ্ধ কোয়ালিশন ইয়েমেনী বন্দরগুলিতে ব্যারন ব্যারন তেল বিক্রি করে চলেছে।

আরব বলয়ের অন্যান্য দেশগুলি, মূলতঃ সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিদ্ধস্থ দেশগুলির ছায়া ইয়েমেনের উপর পড়ছে। ইয়েমেনের এই যুদ্ধ সম্পদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সদ্ব্যবহারের নীতিতে যে ভূরাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সাংবাদসংস্থার অধিকাংশই তা বহাল তবিয়তে এড়িয়ে যাচ্ছে। এই রিপোর্টে শামি বলছেন, “ইয়েমেনের তেল উদারভাবে বিদেশে পরিবহন করা হলেও, দেশের নিজস্ব জনসংখ্যার বেশিরভাগই তাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করতে বাধাপ্রাপ্ত। পিএলসি-র রিপোর্টগুলি ইঙ্গিত করে যে ইয়েমেনের তেল রপ্তানি ২০১৬ সালে বার্ষিক ৬৬.৭২ লাখ ব্যারেল থেকে ২০২১ সালে ২.৫৪৪১ কোটি বেড়েছে।”

পশ্চিমী জটিলতা ঠিক কিভাবে এর জন্য দায়ী?

ইয়েমেনের সম্পদ চুরি করা সম্ভব হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের অনুমোদন এবং তত্ত্বাবধানে, চলমান শোষণে তাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, যা সিরিয়ার অবস্থার থেকে খুব বেশি আলাদা নয়।

কয়েক দশক ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারস্য উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলির জন্য একটি সামুদ্রিক নিরাপত্তার গ্যারান্টার হিসাবে কাজ করেছে, ১৯৮৩ সাল থেকে তার সম্মিলিত মেরিটাইম ফোর্সেস (CMF) জোট পশ্চিম এশিয়ার জলসীমায় অবস্থান করছে। CMF-এর দায়িত্ব লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, আরব সাগর এবং এডেন উপসাগরে ছড়িয়ে আছে – ঠিক যেখানে ইয়েমেনের সম্পদ লুটপাট হয়।

অনেক বিদেশী কোম্পানিও এই চুরি থেকে লাভবান হয়। একটি বিশিষ্ট নাম যা বারবার সামনে আসে তা হল ফরাসি তেল এবং গ্যাস জায়েন্ট Total Energies৷ সংস্থাটির ইয়েমেনে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এর সম্পদের শোষণের উল্লেখযোগ্য ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। সানার সরকারী বার্তা সংস্থা সাবা (SABA) থেকে ২০২২ সালের মার্চ মাসে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে , আরব আমিরাত এবং Total Energies এডেন উপসাগরের বালহাফ গ্যাস টার্মিনালের মাধ্যমে গ্যাস রপ্তানি পুনরায় শুরু করতে সম্মত হয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, নথিটি উন্মোচন করে যে কীভাবে আমেরিকান এবং ফরাসিরা ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘর্ষের সময় প্রতি মিলিয়ন বিটিইউতে মাত্র ৩ ডলারে গ্যাস বিক্রির প্রস্তাব করেছিল, যা বিশ্বব্যাপী মূল্য প্রায় ১৫ ডলারের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এমন তথ্যই উঠে আসছে ক্র্যাডেলের ওই রিপোর্টে।


তবে বর্তমানে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের এজেন্ডাগুলি বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে সাথে এবং তাদের বৈশ্বিক প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ায়, ইয়েমেনে যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা ক্রমশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। উপরন্তু, তারা চীন, রাশিয়া এবং ইরানের ক্রমবর্ধমান চাপের সম্মুখীন, যারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যবস্থার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে পশ্চিম এশিয়ায় একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই গতিশীলতা ইঙ্গিত দেয় যে আগামী কয়েক বছর ইয়েমেন -এর ভাগ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে, জোট এটি পছন্দ করুক বা না করুক।

Leave a comment
scroll to top