১৭ দিন, দীর্ঘ সময়। যান্ত্রিক সমস্যা থেকে প্রাকৃতিক প্রতিকুলতা, সাথে পরিকল্পনায় লাগাতার বদলের পর অবশেষে ধসে যাওয়া সুরঙ্গ থেকে একে একে বেরিয়ে এসেছেন শ্রমিকেরা। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ৪.৫ কিলোমিটার টানেলে আটকে থাকা ৪১ জন নির্মাণ শ্রমিককে অবশেষে আজ মঙ্গলবার উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকারীরা ধ্বংসাবশেষ এবং পাথরের মধ্য দিয়ে প্রবেশিত একটি বড় পাইপের মাধ্যমে একের পর এক চাকা লাগানো স্ট্রেচারে করে শ্রমিকদের বের করে এনেছে।
১৫ দিন যাবৎ মেশিন ড্রিলিং পরিকল্পনার পর ৪৫ মিটার আনুভূমিক ড্রিলিং করে এবং শেষে ব়্যাট হোল মাইনিং পদ্ধতির মাধ্যমে শ্রমিকদের উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করার পরে তাদের শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করার জন্য অবিলম্বে তাদের নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর জন্য নিযুক্ত মেডিকেল টীমগুলি কয়েকদিন ধরেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুসারে, সাম্প্রতিক অতীতেই আশেপাশের অঞ্চলে ভারী যানবাহনের নিয়মিত চলাচলের প্রয়োজনে অবরুদ্ধ টানেলের প্রবেশদ্বার সংলগ্ন রাস্তাগুলি দ্রুত মেরামত করতে হয়েছিল।
ঘটনাস্থলে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে কর্মীদের পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এর জন্য দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা এবং পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হবে। একই সাথে দীর্ঘদিন অনিদ্রা এবং দুঃস্বপ্নের মতো মানসিক সমস্যার সাথে তাদের লড়াই করতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। “৪১ জনই কিছু পোস্ট-ট্রমাটিক উপসর্গ যেমন অনিদ্রা, বারবার দুঃস্বপ্ন, টানেল ধস বারবার ফিরে আসার উদ্বেগ অনুভব করবে,” ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেসের ডাঃ দিনাকরণ ডি আল জাজিরাকে বলেছেন।
হিমালয়ের ভূখণ্ডের প্রকৃতি এবং সরঞ্জামের ব্যর্থতার কারণে উদ্ধার অভিযানে বেশ কিছু সমস্যা হয়েছে, যা উদ্ধারকার্যকে দীর্ঘায়িত করেছে। প্রাথমিকভাবে, খননকারীরা ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে অনুভূমিকভাবে খনন করতে চেয়েছিল। তারা একটি প্রশস্ত স্টিলের পাইপ সরবরাহের পরিকল্পনা করেছিল যা শ্রমিকদের সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ হিসেবে কাজ করবে। যাইহোক, বড় বড় পাথর এই প্রক্রিয়াটিতে বাধা দেয়। সুড়ঙ্গের ভিতরে আলগা ধ্বংসাবশেষ, বোল্ডার, সিমেন্ট ব্লক এবং লোহার রড মিশনটিকে আরও বিলম্বিত করেছিল।
উদ্ধার অভিযানের সময়, এমনকি সবচেয়ে অত্যাধুনিক ড্রিলিং মেশিনগুলি একাধিকবার ব্যর্থ হয়েছিল, যা সরকারি সংস্থাগুলিকে ‘ব়্যাট হোল মাইনিং’-এর মতো আদীম ও ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে বাধ্য করেছিল। মধ্য ভারতের রাজ্যগুলি থেকে আনা এই খনি শ্রমিকরা বিপজ্জনক পদ্ধতি ব্যবহার করে সরু পথ দিয়ে কয়লা খনিতে পৌঁছানোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। প্রায় ৬০ জন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আধিকারিক, ৮০ জন পুলিশকর্মী এবং ২০ জন দমকল আধিকারিক উদ্ধার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিক্স সহ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদেরও এই মিশনে পাঠানো হয়েছিল।
মিশন শেষ হওয়ার সাথে সাথে, শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা, যারা টানেলের বাইরে অপেক্ষায় ছিল, তারা উদযাপন করতে শুরু করে। ড্রিলিং প্রক্রিয়ায় বাধার কারণে বিলম্ব হওয়া সত্ত্বেও, সেই পরিবারের সদস্যরা, সেইসাথে চিকিৎসক এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের একটি দল, আটকে পড়া শ্রমিকদের মনোবল বজায় রাখতে ঘটনাস্থলে নিবেদিত ছিল। এই শ্রমিকেরা গত ১২ই নভেম্বর টানেলে আটকে পড়ে। সেইদিন ভারত তার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দিওয়ালি উদযাপন করছিল। যখন তারা যে টানেলের কাজ করছিল তার একটি অংশ ভূমিধসের কারণে ধসে পড়ে। তারা অক্ষত ছিল এবং সরকারী সংস্থা কয়েক ঘন্টার মধ্যে ওয়াকি-টকির মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল।
এই টানেলটি ভারতের উচ্চাভিলাষী ১৫ কোটি ডলারের খরচ সম্বলিত চারধাম হাইওয়ে প্রকল্পের একটি অংশ, যা উত্তরাখণ্ডের হিন্দু তীর্থস্থানগুলিকে ৮৯০ কিলোমিটার রাস্তার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত করবে আগামী ভবিষ্যতে ৷ গত সপ্তাহে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, বিপর্যয়ের তদন্তকারী বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল বলেছে যে সুড়ঙ্গটির এমার্জেন্সি এগ্জ়িটের কোনও ব্যবস্থা ছিল না এবং এটি সম্ভবত “শিয়ার জোন” বলে পরিচিত, ভূতাত্ত্বিক চ্যূতিরেখার উপর নির্মিত হচ্ছিল, যা ধসের অন্যতম কারণ হতে পারে।