১১ই জুলাই পঞ্চায়েতের ভোট গণনা। কিন্তু এর মধ্যেই ব্যাপক সন্ত্রাস যেন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। সোমবার বিভিন্ন বুথে ছিল পুনর্নির্বাচন। নদীয়া জেলায় মোট ৮৯ টি বুথে এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার ৪৬টি বুথে হয়েছে পুনর্নির্বাচন। কিন্তু আজও সন্ত্রাস থেকে নিষ্পত্তি নেই। গত দুইদিন ধরে রানাঘাটের আনুলিয়া পঞ্চায়েত অঞ্চলে টানা সন্ত্রাসের পর আজও এলাকায় দুষ্কৃতি হানা। কী বলছেন সেখানকার শাসক থেকে বিরোধী?
কী হয়েছে আসলে আনুলিয়া গ্রামপঞ্চায়েত অঞ্চলে?
রানাঘাট ১নম্বর ব্লকের অন্তর্গত আনুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত। মোট সাতাশটি সিট সম্বলিত এই গ্রাম পঞ্চায়েতের তিনটি সিট ঘিরে সন্ত্রাস চলছে ভোটের আগে থেকেই। অন্ততঃ এমনটাই সূত্র মারফত জানা গিয়েছে। বিরোধীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আক্রমণ করা থেকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আটক করার চেষ্টা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ঠিক কী কী ঘটেছে আনুলিয়ায়, আসুন দেখে নিই।
সূত্রের খবর সমস্যার সূত্রপাত হয় ভোটের দিন ৯০/৭৭ নম্বর বুথ থেকে। সেই বুথের তৃণমূল প্রার্থী ছিলেন শুভ ঘোষ। এই শুভ ঘোষের শ্বশুর হলেন এলাকার বিরোধীদের কথিত ‘ডন’ টিঙ্কু সুতার। এলাকার ভোটারেরা জানিয়েছেন শনিবার সকালে ৯০/৭৭ নম্বর সিটের বুথে ছিল না কেন্দ্রীয় বাহিনী। “টিঙ্কু সুতারের ত্রাসেই” সেখানে ভোট দিতে গিয়ে স্থানীয় ভোটারেরা এই মর্মে বিক্ষোভ করেন যে “কেন্দ্রীয় বাহিনী না দিলে আমরা ভোট দেবো না”। ঘটনা চক্রে প্রশাসনিক কর্তারা সেখানে এসে মানুষকে শান্তি পূর্ণ ভোটের আশ্বাস দেন। এলাকাবাসীর বক্তব্য ‘হাওয়া গরম’ থাকায় সেখানে ছাপ্পা করতে পারেনি শাসক দল। কিন্তু এর পর থেকেই আসেপাশের বিভিন্ন বুথে হানা দিতে থাকে দুষ্কৃতির দল।
শনিবার নির্বাচন চলাকালীন শাসকদলের ছাপ্পা ভোটকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ ও রিগিং বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় আনুলিয়া গ্রামপঞ্চায়েতের বুথগুলিতে। বিরোধীদের অভিযোগ, শনিবার আনুলিয়া হাইস্কুলের এবং প্রাইমারি স্কুলের বুথ গুলিতে সশস্ত্র অবস্থায় সিভিক পুলিশের সহায়তায় ছাপ্পা ভোট করতে ঢোকে শাসকদল আশ্রিত দুষ্কৃতিরা। খবর পেয়ে এলাকার লোকজন জড়ো হয়ে সিভিক পুলিশকে আক্রমণ করলে দু্ষ্কৃতিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। তারপর সাধারণ মানুষ ছাপ্পা দেওয়া ব্যালটে জল ঢেলে দেয় বলে অভিযোগ। এমনই আর একটি চিত্র উঠে আসছে ঘোড়াগাছা এবং ঘোষ কলোনির বুথ থেকে। এলাকাবাসীর অভিযোগ সেখানে তৃণমূল প্রার্থী তারক ঘোষ স্বয়ং দলবল সহ ছাপ্পা ভোট দিতে আসে। সেখানেও সাধারণ মানুষের ও বিরোধীদে্য সমর্থকদের আক্রমণের মুখে পড়ে শাসক দলের কর্মীরা। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ছাপ্পা দেওয়া ব্যালট বাক্সে। ঘোষ কলোনির বুথে সিপিআইএমের ব্লক প্রার্থী জয়মঙ্গল ঘোষের উপরেও চড়াও হয় দুষ্কৃতিরা। এলাকার মহিলারা তাকে দুষ্কৃতিদের হাত থেকে উদ্ধার করেন বলে দাবি সিপিআইএমের। কোনও বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল না বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের।
রাতের দিকে এই পরিস্থিতির বদল হয়। শনিবার রাত ১টা থেকে প্রায় টানা তিনঘন্টা এলাকা অবরোধ করে সন্ত্রাস চাললায় বাইক বাহিনী। বিরোধীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আক্রমণ করে দুষ্কৃতিরা। এলাকার সূত্রে জানা গিয়েছে, সুস্থভাবে ছাপ্পা না মারতে পারার আক্রোশে এই আক্রমণ। ওই রাতে আনুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ৯০/৭৭ নম্বর সিটের বিজেপি প্রার্থী ক্ষুদিরাম বর্মনের বাড়িতে মধ্যরাত্রে আক্রমণ করে দুষ্কৃতিরা। তিনি কোনও মতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তার বাড়ির ভেতরে ঢুকে দুষ্কৃতিরা ভাঙচুর ও লুঠপাট করে বলে অভিযোগ। ক্ষুদিরাম বর্মনের পরিবারের তরফে আরও অভিযোগ করা হয়েছে যে তার দাদা দুলাল বর্মনকে মেরে হাত পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, বাড়ির মহিলাদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছে এবং তার ভাইপো মিলন বর্মনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখেছিল দুষ্কৃতিরা। আনুলিয়া হাসাপাতালে যাওয়ার রাস্তা দুষ্কৃতিদের দ্বারা অবরুদ্ধ থাকায় তারা আনুলিয়া হাসপাতালে রবিবার সকাল পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা। পরে তাকে কল্যানি জওহরলাল নেহেরু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে মিলন বর্মনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এই দুই জায়গা থেকেই পুলিশি নিষ্ক্রীয়তার অভিযোগ এসেছে আক্রান্তদের পক্ষ থেকে। এই ঘটনায় এলাকার মানুষ সরাসরি দায়ী করছেন রানাঘাট থানার এস.আই আলতাফ হোসেন বাবুকে। তার বিরুদ্ধে শাসকদলের সাথে যোগসাজশেরও অভিযোগ করছে বিরোধীরা। এর সাথে যাদের উপর সাধারণ মানুষের অভিযোগ তারা হলেন যথাক্রমে টিঙ্কু সুতার, চন্দন পোদ্দার ও জগন্নাথ পোদ্দার। চন্দন ও জগন্নাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই রাতেই দুষ্কৃতিদের বিরোধীদের বাড়ি চিনিয়ে দেয় তারা। তাছাড়াও বিরোধীদের অভিযোগ পরের দিন স্ক্রুটিনি চলাকালীন স্থানীয় মানুষ কে হুমকি দিয়েছেন মুলত তারাই। প্রসঙ্গত, উভয়েই ৯০/৬০ বুথ এলাকার বাসিন্দা এবং চন্দন পোদ্দার স্বয়ং ৯০/৭৮ নম্বর বুথের প্রার্থী ছিলেন। এলাকাবাসীর বক্তব্য অনুযায়ী টিঙ্কু সুতারই এই আক্রমণের কারিগর।
এই দিন রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকারের সাথে কথা হয়েছে ইস্ট পোস্ট বাংলার। তিনি নিজেও সরাসরি এদের দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন। ইস্ট পোস্টকে তিনি জানিয়েছেন, “আনুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় সন্ত্রাসের মূল কারিগর টিঙ্কু সুতার, চন্দন পোদ্দার এবং তার দাদা জগন্নাথ পোদ্দার। এমনকি রানাঘাট ব্লকের অন্যান্য জায়গায় তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বেও মূল ভূমিকা টিঙ্কু সুতারের। এর সাথে থানার এসআই আলতাফ হোসেনও যুক্ত ছিলেন। গোটা এলাকায় সন্ত্রাস মূলত পুলিশের সহযোগিতাতেই হয়। আমি এদের নাম করে উচ্চতর প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি। এসপি সহ রাজ্যপালকেও ই-মেলের মাধ্যমে অভিযোগ জানিয়েছি। যদিও আমায় এখনও কোনো প্রত্যুত্তর করেননি তারা। গণনার দিন কারা কারা সাম্ভাব্য সন্ত্রাস করতে পারে তাদেরও নামের একটি লাস্ট আমি সকলকে পাঠিয়েছি।” এমনটাই সোমবার দুপুরে ইস্ট পোস্ট কে জানিয়েছেন জগন্নাথ সরকার।
কী বলছেন সেই ‘অভিযুক্ত’রা?
চন্দন পোদ্দারকে সোমবার ইস্ট পোস্টের তরফ থেকে ফোন করা হলে প্রাথমিক ভাবে তিনি এমন ভাবেই কথা বলেন যেন তিনি জানেন না আদৌ কোথাও ঝামেলা হয়েছে কি না! কিন্তু তাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, “আমি ৯০/৭৮ এর প্রার্থী ঝামেলা হয়েছে ৯০/৭৭-এ, যা আমার বুথ থেকে অনেকটাই দূরে। সেখানে আমার পক্ষে তখন উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়।” তবে ইস্ট পোস্টের প্রতিনিধিরা এদাকার রেইকি করে জানিয়েছে আদতেই দূরত্ব তেমন কিছু নয়, মাত্র এক মিনিটের হাঁটা পথ। চন্দন পোদ্দারের দাদা জগন্নাথ পোদ্দারকে ফোন করা হলে তিনি জানান, “আমি এই সবের মধ্যে ছিলাম না। আমার বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে ঘটনাস্থল। আপনি এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখুন, আমার বিরুদ্ধে কেউ খারাপ কথা বলবে না।” যদিও এলাকার বিরোধীদের বক্তব্য, উপর মহলে খবর যাওয়ায় ভয় পেয়েছেন তৃণমূল কর্মী জগন্নাথ।
আনুলিয়া পঞ্চায়েত অঞ্চলে সন্ত্রাসের পরদিন এই মর্মে রানাঘাট থানার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল ইস্ট পোস্টের তরফ থেকে। প্রথমে তারা ফোন ধরেননি এবং পরে ফোন সুইচ অফ হয়ে যায়। তাই এসআই আলতাফ হোসেনের কী বক্তব্য তা জানা যায়নি। বর্তমানে সন্ত্রাসের জেরে এলাকার শাসক বিরোধী দলগুলির কর্মী এবং নেতৃত্বরা কার্যত পরিবার সহ ঘরছাড়া হয়েছেন। যদিও সন্ত্রাস থামেনি। যে সিট গুলিতে পুনর্নির্বাচন হবে সেই সিট গুলির ভোটারদের দুষ্কৃতিরা শাসিয়েছে এবং তারা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে কি না, এই মর্মে ব্যালট পেপারের ছবি তুলে রাখতে বলা হয়েছে। এমনটাই অভিযোগ করছেন সেখানকার ভোটারেরা। আগামীকাল ভোট গণনা। এই মুহূর্তে খবর, ১০০ জনের কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা থাকবে গণনা কেন্দ্রে। তাই সেক্ষেত্রে কারচুপি সম্ভব হবে না বলেই জানিয়েছেন প্রার্থীরা।