একদিকে যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ইউনিয়নের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কে রাম নবমী উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার, ৩০শে মার্চ, সাবধান করে দেন যে যদি কোনো ধরণের সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করা হয় তাহলে তাঁর সরকার কড়া ব্যবস্থা নেবে এবং কাউকেই ছাড়া হবে না, তখন অন্যদিকে তাঁরই পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায়, রাজ্যের প্রশাসনিক সদর দফতর নবান্ন থেকে ২ কিঃমিঃ দূরে, হাওড়া জেলার শিবপুরের নানা অবাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে কার্যত তাঁকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গেরুয়া শিবির তাণ্ডব চালায় ও সংখ্যালঘু অবাঙালি মুসলিমদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনে বলে অভিযোগ।
শিবপুর থানার থেকে শুরু করে হাওড়া জুটমিল, অলোকা সিনেমা, চওড়া বস্তি, কাজীপাড়া, পিএম বস্তি, প্রভৃতি অঞ্চলে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুরু হয়ে রাত অবধি দফায় দফায় তাণ্ডব চালায় সশস্ত্র অবাঙালি দুষ্কৃতীরা, যাদের অধিকাংশই নাকি রাম নবমীর মিছিলে অংশগ্রহণকারী। প্রচুর পুলিশী বন্দোবস্ত থাকলেও এই সংবেদনশীল এলাকায় এসে বিকেলের নামাজের সময় রাম নবমীর মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা উত্তেজক স্লোগান দেয় বলে অভিযোগ। ইসলামিক পঞ্জিকার রমজান মাস চলার কারণে উপবাসরত মুসলিমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করলেই উত্তেজিত রাম নবমীর মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা রড, তলোয়ার, দেশি পিস্তল, বোতল ও বোমা নিয়ে আক্রমণ করে সংখ্যালঘু বস্তিগুলোর উপর।
সংখ্যালঘু অবাঙালি মুসলিমদের তরফ থেকে পাল্টা প্রতিরোধ তৈরি হয় পাথর ছুড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখেও জেলা পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়নি। এর পরে রাম নবমীর মিছিলে সামিল হয়ে আসা বহিরাগতরা রাস্তার হকারদের দোকান, ভ্যান রিকশা, সাইকেল রিকশা, প্রভৃতি ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা দুই চাকার বাহনেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর পরে পুলিশ কে টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে লাঠি চার্জ করতে হয় এই সংঘর্ষ থামাতে। দুই পক্ষ ছত্রভঙ্গ হওয়ার পরেও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলতেই থাকে নানা দিকে। পুলিশের রুট মার্চের পরেও রাত অবধি হাওড়া জুটমিল, পিএম বস্তি, প্রভৃতি অঞ্চলে উত্তেজনা বজায় থাকে।
দুই পক্ষের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হলেও সরকারি ভাবে সেই সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। স্থানীয় জৈন হাসপাতাল ও সাউথ হাওড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের থেকেও হতাহতের কোনো পরিসংখ্যান দেওয়া হয়নি। হাওড়া পুলিশ সুপার বা শিবপুর থানার অফিসারেরা হতাহতের সংখ্যা ও সামগ্রিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। শিবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার অরূপ রায় বৃহস্পতিবার রাতে ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানান যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই। কিন্তু উত্তেজনা আর হিংসার চিহ্ন তখনো রাস্তায় রাস্তায় বিদ্যমান।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অঞ্চলে ঢুকে দেখা গেল গোটা রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙা, আগুনে পোড়া রিকশার ফ্রেম, ঠেলার চাকা, এবং পোড়া মোটর সাইকেলের অংশ বিশেষ। রাস্তার হকারদের নানা জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে চতুর্দিকে। পথে বসে সব্জি বিক্রি করেন প্রৌঢ় হায়দার আলী (৫২)। আলী জানালেন তাঁর সব্জির ভ্যান রিকশা পুড়িয়ে দিয়েছে রাম নবমীর মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা। অন্যদিকে স্থানীয় এক বিরিয়ানি বিক্রেতা জানালেন সংঘর্ষ শুরু হতেই আতঙ্কিত হয়ে দোকানে জিনিসপত্র ঢোকাতে গিয়ে তিনি নিজেই পড়ে গিয়ে আহত হন।
রাম নবমীর মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ অভিযোগ করেছে যে তাদের মিছিল নামাজ চলাকালীন একটি মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়েই জৈন হাসপাতালের দিকে অবস্থিত মুসলিম বাড়িগুলোর থেকে তাদের লক্ষ্য করে ইট পাথর ছোড়া শুরু হয়। তার ফলে তারাও দ্বিগুণ আক্রমণ করে পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে বলে দাবি করা হয়। যদিও অঞ্চলের মুসলিম বাসিন্দারা প্রথমে আক্রমণ করার অভিযোগ কে নস্যাৎ করেন এবং বলেন প্রতি বছর এই একই কায়দায় গেরুয়া শিবির অঞ্চলে অশান্তি করে, এবং এই সংঘর্ষ মূলত শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির শক্তি প্রদর্শনে পরিণত হয়।
অঞ্চলের তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি খুরশীদ মাস্টারের সমর্থকেরা তাঁর বাড়ি এবং বিভিন্ন সংখ্যালঘু বস্তিতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেও বৃহস্পতিবারের ঘটনা ও তার সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের যোগাযোগ নিয়ে কেউই সংবাদপত্রের কাছে মুখ খুলতে চাইলেন না। এই দিকে সংখ্যালঘু অঞ্চলের মানুষের দাবি যে রাম নবমী উপলক্ষ্যে বিগত কয়েক বছর ধরে প্রত্যেকবার তাঁরা সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। একই কায়দায় মসজিদের সামনে এসে অশালীন ভাষায় মুসলিম সম্প্রদায় কে কদর্য ভাবে চিত্রিত করে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে প্রতি বছর, যার সাথে তাঁরা অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুসলিম-বিদ্বেষী হিংসার ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছেন। তাঁদের অভিযোগ যে প্রতি বছর একই কর্মকাণ্ড চললেও পুলিশ প্রশাসন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার যেমন কোনো বন্দোবস্ত করে না, তেমনি সশস্ত্র মিছিল কে বোমা, বন্দুক, প্রভৃতি নিয়ে চলতে বাঁধাও দেয় না।
রাজ্য সরকারের তরফ থেকে তাঁর রেড রোডের ডাঃ আম্বেদকরের মূর্তির পাদদেশের ধর্না মঞ্চ থেকে বন্দোপাধ্যায় বিজেপি কে একদিকে সশস্ত্র মিছিল করার অনুমতি দেন, অন্যদিকে তিনিই আবার হুমকি দিয়েছিলেন যে কোনো ভাবেই মুসলিমদের উপর আক্রমণ হলে তাঁর সরকার বসে থাকবে না। তার পরেও হাওড়ার শিবপুরে যে ভাবে পুলিশের সামনেই সশস্ত্র রাম নবমীর মিছিল থেকে মুসলিমদের লক্ষ্য করে আক্রমণ করা হল, তার ফলে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল বলেই অভিযোগ করলেন অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ।