এদিকে ভারতে রাম মন্দিরে প্রান প্রতিষ্ঠা না কি সব যেন হয়ে গেল দেখলাম। এই বছরে লোকসভা ভোটের ফলাফল এখনই নির্ধারণ হয়ে গেল। ধর্ম নামক মাদকের কাঁধে চড়ে ভারতের সমস্ত সমাজ এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা এক বিধ্বংসী মোড় নিতে বাধ্য হলো। জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভ এবং হাহাকারের মধ্যে এক অন্ধ দামাল গেরুয়া দম্ভ ভারত ছেয়ে গেল। মুম্বাইয়ের মীরা রোডে প্রায় কয়েকশো মুসলমান নাগরিক নিজেদের পাড়ায় আসা এই গেরুয়া বাহিনীর তান্ডব রুখে দেওয়ার জন্য এবং নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য যখন সেই রাতে এই বাঁদর সেনার মুখোমুখি দাঁড়ালো তখন ঠিক তার পরের দিন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বুলডোজার মডেল প্রয়োগ করলো। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতবর্ষে অলিখিতভাবে হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপন হয়ে গেল।
এত কিছু কোলাহলের জন্য মুম্বাই থেকে কত তারকা অযোধ্যা ছুটে গেল রাজামশাইয়ের তোষামোদ করতে, কত কত মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, এমনকি কত কাছের বন্ধুও বয়ে গেল এই ধর্মের উন্মত্ত প্লাবনে। অন্ধের মতো ধর্মকে আফিম বানিয়ে নিজেদের জীবনে মাথা পেতে গ্রহন করে নিল কত কোটি কোটি সর্বহারা ভারতবাসী। ঠিক যেমন অনেক মুসলমান দেশগুলোতে দেখা গিয়েছিল, সেই ধরনের কঠোর মূর্খামি যেন নজরে পড়ছে এখন। এইসব বিষয় নিয়ে সৌদি আরবের এক বিশেষ সম্পর্ক আছে, এক ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে, তা নিয়েই আসছি। কিন্তু দেশের এই ধর্মীয় বিষাক্ত মেরুকরণ নিয়ে যেমন হতাশ হতে মন চাইছে, তার থেকেও বেশি রাগ হয়ে ফুটে বেড়োতে চাইছে।
আমরা সকলেই দেখেছি আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের কি পরিস্থিতি হয়েছিল। ধর্মের কারবার করতে গিয়ে এইসব দেশগুলো আজ কোথায় এসে পৌঁছেছে তা নিয়ে আর আলাদা করে বলতে হয়না। আফগানিস্তানে এক সময়ে যখন বামিয়ান বৌদ্ধ বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, আজ সেই তালিবানই সেই ধ্বংসস্তূপ টা পর্যটন কেন্দ্র বানানো নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে, যখন বুঝলো যে মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদ রুখতে গিয়ে ধর্মের আশ্রয় নিয়ে সেই দেশের বাকি ব্যবসা গুলোও বানচাল হয়ে গেছে। বাংলাদেশে যখন স্লোগান উঠেছিল, “সবাই হবো তালিবান, বাংলাদেশ হবে আফগানিস্তান” তখন ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য দেশের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব যে কোন অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে তা নিয়ে আরও অনেক উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে।
তা এইসব নিয়ে এত আলোচনা বিশ্লেষণ করার কি মানে? তালিবানদের পূর্বপুরুষ মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে সোভিয়েতরা অনেক যুদ্ধ চালিয়েছিল সেই অঞ্চলের ধর্মান্ধতা রুখতে, কিন্তু আমেরিকার সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতার কারনে তা আর হয়ে উঠেনি। এমনকি, এই ক্ষেত্রে এক অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যখন হলিউডের “রাম্বো ৩” রিলিজ করেছিল তখন নাকি সিনেমাটার শেষে “এই মুভিটি আফগানিস্তানের সাহসী মুজাহিদদের উৎসর্গ করা হচ্ছে” লেখা আসতো সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, যেটা ৯/১১-র হামলার পর “মুজাহিদ” শব্দটি পালটে গিয়ে “সাহসী নাগরিক” হয়ে গিয়েছিল! সমাজতন্ত্র ঠেকিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী লুঠপাট চালানোর জন্য ধর্ম কে নানা ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। এই একই বিষয় আসলে সৌদি আরবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
তাকফিরি, দায়েশ, তালিবান, মুজাহিদিন, এই সমস্ত মৌলবাদী উগ্রপন্থী ভাবধারা যে মার্কিনী প্রশ্রয়প্রাপ্ত তা নিয়ে কোনো ব্যাক্তিরই কোনো সন্দেহ নেই আর। কিন্তু এরই মধ্যে ওয়াহাবি ইসলামের স্থানটাও এখন সরাসরি ভাবে সামনে এসে গেছে। সৌদি যুবরাজ নিজে স্বীকার করলেন যে সমাজতন্ত্র ঠেকাতেই ওয়াহাবি ইসলামের হাত ধরে দেশটাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। এতে তিনি বলেন, গত শতকের ৭০ এর দশকে পশ্চিমারাই ওয়াহাবিবাদের প্রচারে সৌদিকে অর্থ ঢালতে অনুরোধ করেছিল। মুসলিম দেশগুলো যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ে চলে না যায়, সেজন্যই তারা এ অনুরোধ করেছিল। সেই অনুরোধে বিভিন্ন দেশে মসজিদ-মাদ্রাসায় অর্থ ঢেলে ওয়াহাবি মতাদর্শের বিস্তারে কাজ শুরু করে সৌদি আরব। কিন্তু এখন যখন আল্লাহর আশীর্বাদে প্রাপ্ত তেল খনিজ সম্পদ ফুরিয়ে আসতে চলেছে, তখন তো আর ধর্ম দিয়ে অর্থনীতি এবং আধিপত্য টিকিয়ে রাখা যাবে না। তখন তো আর ওয়াহাব কেন স্বয়ং খোদা এসেও দেশকে তুলে ধরতে পারবে না। যেই কারনে এত পবিত্র ভূমিতেও শেষ পর্যন্ত মদ্যপানের ব্যবস্থা করতেই হলো ব্যবসা বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে। এবার দেখতে হবে, আমাদের দেশে ধর্মের নেশার গুলি খাইয়ে বেকার ক্ষুধার্ত মানুষদের ধৈর্যের বাঁধ কত দিন ধরে রাখা যায়।