বাহরাইনে জনপ্রিয় বাঙালি গায়িকা লগ্নজিতা আসছেন এই সামনের দোসরা এবং তেসরা ফেব্রুয়ারি! বাহরাইনের বঙ্গীয় সমাজের পক্ষ থেকে এই আয়োজন করা হয়েছে, বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন হতে চলেছে। শিল্পী লগ্নজিতা এবং তার টিমের ভিসার কাজ চলছে, ইতিমধ্যে ওনাদের হোটেল রুম বুকিং, গানের শোয়ের হল বুকিং সমস্ত কিছু সেরে ফেলা হয়েছে জানা গেল। বাহরাইনের রাজধানী মানামা শহরে ইন্ডিয়ান ক্লাব অডিটোরিয়ামে আগামী মাসের দুই তারিখ সন্ধ্যাবেলায় লগ্নজিতার কনসার্ট। বেশ এলাহী এবং বিলাসবহুল আয়োজন হতে চলেছে, ভালোই খরচা করে সমস্ত কিছু ব্যবস্থা করা হচ্ছে দেখলাম। দেখে যা মনে হলো, প্রত্যেক বছর এরকম কোনোকিছু উদযাপন হয়েই থাকে, এবং বঙ্গীয় সমাজের উদ্যোগে বারো মাসে তেরো পার্বণ না হলেও ষোলো আনা বাঙালিয়ানার উৎসব লেগেই থাকে!
আমি এই সমস্ত আয়োজনের টিকিট খরচা মিলিয়ে দেখলাম। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের টিকিট খরচা সাত বাহরাইনী দিনার, অর্থাৎ দেড় হাজার ভারতীয় মুদ্রা ছাড়িয়ে। সঙ্গীতানুষ্ঠানের পরের দিন আবার শিল্পীর সাথে মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন করা হয়েছে। সেই সুযোগ প্রাপ্তির টিকিট খরচা দশ দিনার অর্থাৎ প্রায় ২২০০ টাকা একজন ব্যক্তির জন্য। মানামা শহরে পৌঁছে থাকা খাওয়ার খরচ আলাদা এবং আরো অনেক বেশি, এবং অনুষ্ঠানের সময়ে পার্কিংএর খরচা তো আছেই। এতকিছু সৌদির কোনো শহরে করতে গেলে আরো অনেক বেশি খরচা হয়ে যেত, এবং বাহরাইনের বঙ্গীয় সমাজ কিছু বিশেষ কারনে আরেকটু বেশি সজীব রিয়াধের তুলনায়, যেহেতু বাহরাইনে দূর্গাপূজা এবং আরো বেশকিছু আনন্দোৎসব অনুমোদিত। সৌদিতে এখন সরাসরি ভাবে নিষিদ্ধ না হলেও, ইসকন সমিতি নিজেও এখনও পুজো করার সাহস দেখায়নি।
এই পরিস্থিতিতে সৌদি আরবে থাকা প্রবাসী বাঙালিরা দূর্গা পুজো উদযাপন করার জন্য, এবং আরো নানা আমোদ প্রমোদের জন্য সীমান্ত পেড়িয়ে বাহরাইন অথবা দুবাই পৌঁছে যান নিজেদের সময় এবং সুবিধা অনুযায়ী। যতটা সম্ভব রিয়াদ শহরেও কলকাতার হিন্দু বাঙালি সমাজ “বঙ্গমৈত্রী” কিছু উৎসব পালন করেন, যেমন দুর্গোৎসবের সময়ে বিজয়া দশমী এবং কালীপূজা একসাথে মিলিয়ে বিজয়া সম্মেলনী পালন করা হয়েছিল, যেটায় আমি ভাগ নিতে পেরেছিলাম। সেটার এন্ট্রি লেগেছিল প্রায় আড়াই হাজার টাকা মত। বেশ ধুমধাম করেই তা পালন করা হয়েছিল এবং আমি তো স্টেজে আবৃত্তি ও সঙ্গীত পরিবেশনাও করেছিলাম! এর থেকেও জমজমাট ভাবে বাঙালি নববর্ষ উদযাপন করা হয় কিন্তু তার এখন অনেক সময় আছে। মোটামুটি বেশ ঝাঁ চকচকে আলো রোশনাই সহ এইসব উৎসব উপভোগ করা হয় এই প্রবাসী হিন্দু বাঙালীদের মধ্যে।
এইবার প্রশ্ন উঠছে এতদিন যাদের নিয়ে এত চিঠি লিখলাম, তাদের ভূমিকা এর মধ্যে কোথায়? এমন নয় যে আমি শুধু মুসলমানদের সাথে অথবা অন্য দেশীয় শ্রমিকদের সাথে বাস করি, আমার সাথে তো হিন্দু বাঙালিও ছিলেন শ্রম দেওয়ার জন্য। তাদের নানা কাহিনী শুনিয়েছি, তাহলে এখন কাদের কথা বলছি আবার? এই ধরনের উৎসব পালন হচ্ছে মধ্য এবং উচ্চ শ্রেনীর হিন্দু বাঙালিদের, যারা “সম্মানিত” হোয়াইট কলার চাকরি করেন, যারা নিজেদের পরিবার সঙ্গে নিয়ে এসে বিদেশে থাকতে পারেন। এবং তারা বেশিরভাগই এক হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদী মনোভাব পোষণ করেন, যার প্রতিফলন ঘটে এইসব পার্বণের মাধ্যমে।
কেন এই কথা বলছি? কারন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি সংস্কৃতি রক্ষার দোহাই দিয়ে এই সমস্ত উৎসব এবং প্রমোদের বদলে শ্রমিকদের প্রাণ রক্ষা করতে পারেন না? আমি যাদের সাথে থাকি, কাজ করি, সমস্ত সুখ আহ্লাদ দুঃখ বেদনা ভাগ করে নিয়ে থাকি তারা সেই সব উৎসবে প্যান্ডেল খাটাচ্ছেন। তারাও বাঙালি, সবাই হয়তো হিন্দু নয়, কিন্তু দূর্গাপূজা নিয়ে টনটনে জ্ঞান। কিন্তু তারা এখন অত হাজার হাজার টাকা গচ্ছা দিয়ে উৎসব করতে আসেননি দেশ থেকে এত দূর। কাতারে বিশ্বকাপের সময়ে এত প্রবাসী শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন যে পৃথিবী জুড়ে নানা মানবাধিকার সংগঠন প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হয়েছিল। কোনো ভারতীয় শ্রমিক নিজের সমস্যা, আবেদনপত্র নিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের দ্বারস্থ হলে তার দিকে কেউ ঘুরেও তাকায় না, পুলিশ ডেকে আবার সেই কঠিন দাসত্বের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, নাহলে মাসের পর মাস তাকে ঘোরাতে থাকে। এত এত উচ্চপদস্থ বাঙালী, হিন্দু মানুষজন খোদ দূতাবাসের উৎসব উপভোগ করে আসছেন, তারা কি এতই ঠুঁটো যে সেই সর্বহারা প্রবাসী শ্রমজীবী ভারতীয়দের জন্য একটা আওয়াজ তুলতে পারে না? তাদের শুধু সেই বিজয়ার উল্লাস করতেই দেখলাম, কিন্তু যখন একের পর এক শ্রমিক আত্মহত্যা করছেন অথবা প্রতাড়িত হচ্ছেন, তখন তো আর দেখা মেলে না। সৌদি আরবে বিজয়া করে, অথবা বাহরাইনে কনসার্টে দেদার মদ্যপান করেই তাদের বাঙালি সত্ত্বা প্রকাশ পায়, পাশে বসে থাকা মুর্শিদাবাদের বাঙালী ছেলেটা যাকে এইবারের মাইনেটা না এলে গলায় দড়ি দিতে হবে, তার সুরাহা বার করতে গেলে হয়তো সেই উচ্চ জাত চলে যাওয়ার ভয় থাকে।