খিদে কাকে বলে জানেন? কোনো মানুষ বছরের পর বছর ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুঁড়ে দূর বিদেশে পড়ে থাকতে কেমন লাগে জানেন? পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য পরিবারকে এত দূরে রেখে এসে নিজেরই ভাত জোগাড় না করতে পারার অনুভূতি টা কলকাতার কোনো চার কামরার ফ্ল্যাটে বসে বোঝা যায় না। সেই সমস্ত কিছু অনুভূতির কাহিনী শোনাবো আজ, যখন শ্রমিকদের এত দূরে নিয়ে এসে এত রকমের আইনকানুনের ধার না ধরে কিভাবে পুঁজিবাদের সর্বস্তরের দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের একজন পাকিস্তানী গাড়িচালক ছিলেন, হাফিজ(নাম পরিবর্তিত)। তিনি আমার সমবয়সী হলেও তাঁর অনেক বেশি অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল সৌদি আরবে এই ধরনের প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্ভোগ নিয়ে।
প্রথমেই জানিয়ে রাখি যে পাকিস্তানি দের এই দেশে কিরকম পরিস্থিতি। গত বছর সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি জারি করা হয়েছে যেন তারা আর এই দেশে ভিখারি, পকেটমার না পাঠায়! এবং এই অদ্ভুত নির্দেশিকা হাস্যকর মনে হলেও এ এক অত্যন্ত দুঃখজনক এবং ভয়ানক সত্য। প্রতি বছর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের মতো বহু পরিমানে শ্রমিক আসেন গাল্ফ দেশগুলিতে, এবং তাদের মধ্যে এক বৃহৎ অংশকে দুর্ভাগ্যবশত ওই ধরনের কাজে নামিয়ে দেওয়া হয়। তাদের ঠকিয়ে দালালরা নিয়ে আসে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে, অথবা জানিয়েই তাদের নিয়ে এসে ভিক্ষাবৃত্তিতে লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারাও ভেবে নেয় যে অল্প শ্রমে বিদেশে আয় হয়ে যায় যদি। দেশে কোনো চাকরি না জোটাতে পেরে এহেন চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় শয়ে শয়ে মানুষ। একবার এক ফাঁকা গলিতে আমি এমন এক ছেলের সম্মুখীন হয়েছিলাম, একেবারে চোস্ত ইংরেজি বলে ভিক্ষে চাইছিল, এই বলে যে ওকে নাকি দালালরা এই দেশে ওকে নিয়ে এসে ছেড়ে দিয়েছে, চাকরি নেই, খাবার নেই, পয়সা নেই, কি করে ফেরত যাবে জানে না, খুব খারাপ পরিস্থিতি। তাতে আমার মন অবশ্য গলেনি, তাড়িয়ে দিয়েছিলাম কারন প্রথমত সৌদি পুলিশ এইরকম কাউকে দেখলেই তাকে ধরে নিয়ে যাবে, তার ওপর আমি এই কাজটা কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারি না।
তা যাই হোক, যারা এইসবে না গিয়ে সঠিকভাবে, নিজে খেটে চাকরি করছে, তাদের কি অবস্থা? হাফিজ নিজের পুরোনো কোম্পানির কথা জানালো। আমাদের ড্রাইভারের কাজ করার আগে হাসপাতালে কাজ করতো। সেই হাসপাতালের মালিকের নাকি আরো বেশ কয়েকটা, বোধহয় আটটা আরো হাসপাতাল ছিল। এখন নাকি তা শুধু একটায় এসে পৌঁছেছে। এত দুরবস্থা কি করে হলো? বোঝা গেল সেই মালিক যেইসব ম্যানেজারদের নিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের চূড়ান্ত অকর্মণ্যতার জন্য এবং অবশ্যই লোভের দায়ে এই সর্বনাশ হলো মালিকের। এবার তাতে বড়লোক পুঁজির ঢিবির ওপর বসে থাকা মালিকের যত না ভোগান্তি হয়েছিল, তার থেকে অনেকটাই বেশি ভুগতে হলো সর্বহারা শ্রমিকদের। যারা সবকিছু ছেড়ে এসেছে দুপয়সা কামানোর জন্য, তাদের একেবারে দিশেহারা করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো।
অতজন শ্রমিকদের হকের টাকা মেরে দেওয়া শুরু হলো। আমি হাফিজকে কোম্পানির আমাদের অনেক টাকা মেরে দেওয়ার কথা বলছিলাম, সে হাসতে হাসতে জানালো যে ছয় সাত মাসের টাকা বাকি আছে তার এবং তার মতো আরো অনেকের। এবার অনেকে অনেকরকম পদ্ধতিতে নিজেদের টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে রাখতো কিন্তু কোনো কিছুতেই খুব একটা লাভ হচ্ছিল না। একজন তো নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েও কোনো সুরাহা পাওয়া গেল না। আমি জানতে চাইলাম যে এই অবস্থায় তো আধিকারিকদের তো তৎপরতার সাথে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। হাফিজ জানালো, যদি সৌদি মালিক সৌদি আধিকারিকদের একটু ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেয় যে তার প্রায় দেউলিয়ার মতো পরিস্থিতি, তার আর মাইনে দেওয়ার টাকা নেই, তখন নাকি মাসের পর মাস বিনা মাইনেতে অত শ্রমিকদের কাজ করানোর দায় হাসিমুখে মাফ হয়ে যেত…