সৌদির চিঠি : ভিনদেশে নিশ্ছিদ্র মায়াজাল, পর্ব-৭
বিদেশে থাকার যে কত রকম সুবিধা হতে পারে, সব শিখছি আস্তে আস্তে। প্রবাসী বাঙালিরা বিদেশে কাজ করলে তাদের কাছ থেকে অনেক রকমের আশা থেকেই যায় তাদের কাছের মানুষদের। এখানে কাছের মানুষ বলতে শুধু তাদের পরিবারের কথা বলছি না। যেমন, সেদিন চাপড়া অঞ্চলের এক দাদা শোনাচ্ছিলো ওদের গ্রামগুলোর গল্প। ওদের পাশের গ্রামের নাম ডোমপুকুর, সেখানে নাকি এমন কোনও বাড়ি নেই যেই বাড়ির ছেলে বিদেশে নেই। প্রত্যেক পরিবারের অন্তত একজন সদস্য বিদেশে চাকরি করে। কথা শুনে আন্দাজ করলাম বেশিরভাগ মানুষ তার মানে মিডল ইস্টেই অবস্থিত আমাদের মতো। এবং এক অলিখিত নিয়মের মাধ্যমেই যেন সবাইকে একটা দায়িত্ব পালন করতেই হয় -যত প্রবাসী সেই গ্রামের বাসিন্দারা হয়তো আশেপাশের গ্রামগুলোর মতো লেখাপড়ায় অত এগিয়ে নেই কিন্তু তাদের গ্রামে পুকুর বাঁধানো, পাকা রাস্তা, সিমেন্টের বাড়ি, মসজিদের নির্মানকাজ, গ্রামের স্কুলের দেখভাল করা, এই ধরনের নানা বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। নদিয়া জেলায় এরকম অনেক গ্রামে এই ধরনের কোনো প্রবাসী কোঅপরেটিভ ফান্ডের মাধ্যমে অনেক উন্নয়ন কাজ হওয়ার কথা শোনা গেছে।
এই ঘটনাটি বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য বলা যেতে পারে বাংলাদেশের জন্যেও। গত সপ্তাহে ওপারের কুষ্টিয়া জেলার একটি ছেলে জাহির(নাম পরিবর্তিত), আমাকে বারবার ডাকছিল এরকম একটা বিষয় দেখানোর জন্য। সকালে ওর সাথে দেখা হতেই সেদিন ওর মুখটা কেমন যেন ঝলমল করে উঠলো, ভীষণ আনন্দ এবং উৎসাহের সাথে আমায় ডাকতে লাগলো, “ভাই একবার আসেন, একবার দেখে যান কি মেসেজ এসছে। এই মাত্র এলো”। কি এমন মেসেজ যা ওকে এত আনন্দ দিল দেখতে যেতে জানতে পারলাম, ওর গ্রাম থেকে সেই মাসের হিসেব পাঠানো হয়েছে, এবং সেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে গ্রুপ কল শুরু হয়েছে সেই নিয়ে। আমায় অনেকবার ডাকলো সেই কলে ওর সাথে থাকার জন্য, কিন্তু সেই সময়ে ব্যস্ততা এবং সামান্য লজ্জার কারনে আর যোগ দিলাম না তখন। কে কত টাকা দিয়েছে সেই মাসে, এবং কি কি খাতে তা খরচা হয়েছে, এক বিস্তারিত হিসেব এসেছে। গ্রামে কোনো দুঃস্থ পরিবারের সাহায্য থেকে শুরু করে কোনো নতুন মসজিদের জলের ট্যাঙ্ক লাগানো, সমস্ত কিছু দাবি মেটানো হচ্ছে সেই গ্রামের প্রবাসী শ্রমিকদের স্বেচ্ছায় এবং সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগের দান করা ফান্ডের থেকে। ইউপির এক প্রবীন শ্রমিক আমাকে অনেকদিন আগে এরকম এক প্রস্তাব দিয়েছিলেন নিজের গ্রামে এরকম শুরু করতে চান বলে। উনি তো গ্রামের গরীব মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটাকেও এধরনের গ্রামবাসীদের সামগ্রিক দায়িত্ব হিসেবে ধরে নিলেন। এই ক্ষেত্রে মনে পড়ে গেল, অনেকদিন আগে পিসি কে বলতে শুনেছিলাম, কেরালার ব্যাপারে। পিসির মনে হয়েছিল যে যেহেতু কেরালা রাজ্যের প্রচুর মালায়ালম ব্যাক্তি এরকম গাল্ফে চাকরি করেন, তাই তাদের পাঠানো টাকাতেই নাকি সেই রাজ্যের অনেক উন্নতি হচ্ছে। আজ চাক্ষুষ দেখে বুঝলাম কি থিওরিতে এরকম এক বিরাট আকারের সামগ্রীকভাবে উন্নয়ন সম্ভব।
আজকের লেখাটি ছাপার আগে, এক বিশেষ ঘটনা, যা প্রকাশনার কয়েক ঘন্টা আগেই ঘটে গেল, তা না জানিয়ে থাকা যাচ্ছে না। এক নেপালি কর্মচারী বিকাশ (নাম পরিবর্তিত) আছেন আমাদের সাথে, তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড়ো বেশ খানিকটা এবং বলতে গেলে বেশ বদরাগী স্বভাবের। কেউ ঝামেলা করতে এলে সিনিয়র জুনিয়র কিছু দেখেন না, পাল্টা অনেক কথা শুনিয়ে দেন। আজ এক কাঠি ওপরে গিয়ে আমাদের সিনিয়র শেফের একেবারে গায়ে হাত তুলে দিয়েছেন! এমনিতেই সেই শেফ কে তার গালিগালাজ এবং চেঁচামেচির স্বভাবের জন্য আমরা অনেকেই সহ্য করতে পারি না, বিকাশদা তো দূরের কথা। বিকাশ আগুপিছু ভাবে না, ঠোঁট কাটা মানুষ, রেগে গেলে প্রকাশ করে ফেলেন, আমার মত চুপচাপ মেনে নেন না কিছুতেই। ক্লাস টু পাস মধ্যবয়স্ক মানুষ-টি তো আর আমার মতো ক্যারিয়ারের কথা ভেবে এখানে আসেননি, দু পয়সা রোজগার করে নিজের পরিবারের কথা ভেবে এসছেন। কেনই বা অকারনে অপমান, তাচ্ছিল্য অবহেলা মেনে নেবেন?
কান্ডটি ঘটানোর পর শেফ সঙ্গে সঙ্গেই হেড অফিসে ফোন করে বিকাশকে ছাঁটাইয়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন, কিচেন থেকে তাড়িয়ে দিলেন। কিছুক্ষন পরে আমাদের সবাইকে ডেকে এই নিয়ে এক জ্বালাময়ী এবং জ্বালা মাখানো বক্তৃতা শোনালেন, যে উনি একেবারেই এই ব্যবহার বরদাস্ত করবেন না, বাকি কেউ ওনার গালিগালাজ শুনতে না চাইলে এখনই তাকেও বার করে দেওয়া হবে, ইত্যাদি। এর আগে নিজের চোখে দুটো ফায়ারিং দেখার পর, সুযোগ বুঝে আমি ফস করে একটু করুন গলায় অনুরোধ করে ফেললাম যাতে অন্ততঃ বিকাশের দুর্দান্ত কাজ এবং ওর ৩টে ছোট ছোট সন্তানের কথা ভেবে এইবারের জন্য ওকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আমার সাথে বাকিরাও বলতে লাগলো এইবার বড়ো ভুল করে ফেলেছে আর কখনো হবে না, যেন এইবারের মতো ছেড়ে দেয়… কিন্তু শেফের গোঁসা আর অহংকার অত সহজে ভাঙবে কি করে! শেষে প্রায় আধ ঘন্টা পর, অনেক চেষ্টার পর শেফের মাথা ঠান্ডা হওয়াতে শেফ রাজি হলেন ওকে ক্ষমা করতে। নাহলে দেখলাম সত্যিই ওর ছাঁটাইয়ের নোটিশ ছাপা হয়ে যাচ্ছিল।
এতক্ষণ এত ব্যাপার বিকাশ একটা আওয়াজও বার না করে চুপচাপ দুরে দাঁড়িয়ে সব দেখে গেল। ওর চাকরি বেঁচে যাওয়াতে না আমাদের ধন্যবাদ জানালো, না আমাকে ওর হয়ে ওকালতি করার জন্য কথা শোনালো। নিজের আত্মমর্যাদা এবং অভিমান থেকে একচুলও যে ও নড়বে না, এবং সুযোগ পেলে আবার আরও কঠোর প্রতিবাদ করতে পিছু হটবে না, তার ওই ছোট ছোট দুটো জ্বলন্ত চোখই বুঝিয়ে দিল। কিন্তু এই ব্যাপারটা জেনে আমার সেই শান্তিপুরের কলিগ আশিষ আমার ওপর বেশ চটে গেল। শুনেই সে সেই কথাটা বলে উঠলো যেটা বাকি সমস্ত লেবারের মাথায় তখন ঘুরছে, “ও যা করেছিল একদম ঠিক করেছিল, আরও বেশি মার দিলে ভালো হতো। ওই শেফেরও ভয় পাওয়া উচিত। তুই কেন ক্ষমা চাইলি? ও নিজে যখন বলছে যে ও ওর ভালো টা বুঝে নেবে কিন্তু অপমান মেনে নেবে না! এত সাহসিকতা দেখানোর পর, তুই কোন দুঃখে ওর হয়ে ক্ষমা চাইতে গেলি?”