Close

সৌদির চিঠি: রূপকথার দেশের ইতিকথা জানালো সাবির(পর্ব ১০)

রূপকথার দেশ সৌদি আরব। সৌদির ইতিবৃত্তান্তও রূপকথার মতো। সেই রূপকথার গল্পই শোনালো স্থানীয় এক পরিবারের কর্তা সাবির।

Creator: rawpixel.com | Credit: rawpixel.com

সৌদির চিঠি: আমার প্রমোশন, গুডবাই জেড্ডাহ; পর্ব- ৯

সৌদি আরব অনেকের কাছেই যেন এক বিচিত্র দেশ মনে হবে। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে অথবা চিন্তা করলে, মনে হবে, এমনটাই তো হওয়ার ছিল! এরকম নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছি রোজ। এখানকার স্থানীয় মানুষদের সাথে নিজের অভিজ্ঞতা যে কত অদ্ভুত এবং আকর্ষণীয় হতে পারে তা তো এখনও জানানোই হয়নি। এখানে কিছুদিন আগে এক স্থানীয় পরিবারের সাথে আলাপ হলো, বেশ অদ্ভুত পরিস্থিতি তে। একদিন মাঝরাতে সাবির (নাম পরিবর্তিত), আমাদের হোটেলে হঠাৎ এসে পৌঁছালো, খেতে নয়, এমনিই দেখতে। আমায় সামনে পেয়ে আমার পিৎজা ওভেন নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। আমি ভাবলাম হয়তো কোনো গেস্ট কিরম পিজা খেতে চলেছে সেই নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করছেন। পরে বুঝলাম, উনি নিজের পিজার দোকান দিচ্ছেন, এবং সেই নিয়ে পুরো শহর জুড়ে নানা জায়গা থেকে শিক্ষা সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছেন। শুনে যেমন ভালো লাগলো, তেমনি দুশ্চিন্তাও হলো এই ভেবে যে এমন এক ব্যবসা শুরু করার আগে কেন আরেকটু ভালো ভাবে তৈরি হয়নি!

আমার সাথে তার দুই মিনিট কথা বলার পরেই তিনি আমার ফোন নাম্বার নিয়ে নিলেন। তিনি জানালেন যে আমি যদি তার দোকান ঠিকঠাক ভাবে প্রতিষ্ঠা করে দিতে সাহায্য করি তাহলে তিনি আমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবেন। বেশ লোভনীয় প্রস্তাব। আমিও সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলাম। পারিশ্রমিক চুলোয় যাক, এই ধরনের অভিজ্ঞতাটাই এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে আমার কেরিয়ার শুরু করতে। সেই কাজে লাগতেই সাবির এবং তার পরিবারের সাথে আলাপ হয়ে গেল, যার সূত্রে একে অপরের মধ্যে নানা গল্প শুরু হলো। সাবির একজন ভীষণ খোলামেলা, মিশুকে মানুষ। কোনো রাখঢাক নেই, সত্য কে সত্য হিসেবে দেখতে, চিনতে এবং সম্মুখীন হতে জানেন। একেবারে নির্ভীক ভাবে, কোনোরকম লজ্জা ছাড়াই অনেক কথা বলে গেলেন সৌদির ব্যাপারে। নিজের জীবনকাহিনি এবং এই দোকানটি দেওয়ার পেছনে ওনার উদ্দেশ্য সমস্ত কিছু বিস্তারিত বোঝানোর জন্য সৌদি আরবের আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থা নিয়ে অনেক কথাই বেশ উৎসাহের সাথে বললো।

দশ বছর আগে, সৌদির যা অবস্থা ছিল তার সাথে আজকের দিনের বিস্তর ফারাক। তেলের প্রাচুর্যে ডুবে থাকা এই মরুভূমির বাসিন্দারা অভাব বলতে কিছু বুঝতেন না, রাজকোষ থেকেই সবার ভরনপোষন চলতো। শুনতে অনেকটা রুপকথার গল্প মনে হবে জানি। হাজার হোক, আরব্য রজনীর মাঝেই বাস করছি! রাজা নাকি তার প্রজাদের কোনো পাওনা বাকি রাখেননি, সাবসিডি আর জিনিসপত্রের কম দাম এইসব নিয়ে সবাই বেশ ভালোই দিনকাল কাটাচ্ছিলেন। সমস্ত রকমের খাটুনির কাজ অথবা চাকরি করানোর জন্য তো কম খরচায় জোগাড় হওয়া এক বিশাল প্রবাসী শ্রমিক বাহিনী আছেই।

তারপর এলেন এক নতুন রাজা, এবং তার সঙ্গে একজন অত্যন্ত তুখোড়, প্রভাবশালী, এই যুগের রাজপুত্র। গাল্ফে যেই হারে তেল শুষে নেওয়া হচ্ছে, তা চলতে থাকলে যে আর বেশিদিন তেলের দয়ায় তাদের এত আনন্দ এবং প্রতিপত্তি থাকবে না তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। এই কারণে রাজা অনেক পরিবর্তন আনলেন। অনেক সাবসিডি, বেকার ভাতা বন্ধ করে দিলেন। রাজ্যের মানুষের কাছে ডাক পৌঁছালো, “অনেক ফুর্তি হয়েছে, এবার কাজে নামো!” সমস্ত রকমের চাকরি আমাদের মতো প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য খুলে রাখা আছে বলে এবার সেসবেও কোপ পড়লো। এতদিন সরকারি ভাতা পেয়ে বসে থাকা সৌদির জনগনকে কাজে নামতে নির্দেশ দেওয়া হলো। সমস্ত কোম্পানিতে বাধ্য করে দেওয়া হলো যেন এক নির্দিষ্ট শতাংশ স্থানীয় কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়। সাবির এই কারনে শুধু চাকরি নয়, নিজের দুই সন্তানের খরচা সামলানোর জন্য একটি বই খাতার দোকান এবং এখন একটা পিজার দোকান দিয়ে ব্যবসাতেও নেমে পড়তে বাধ্য হলেন। কানাডাতে ইন্জিনিয়ারিং পড়ে আসা সাবির যাতে নিজের সন্তানদের কেও নিজের মতো এক সুবিধাপূর্ন জীবন দিতে পারেন, সেই বিষয়ে কোনো কমতি রাখতে নারাজ। এতকিছু এক নিশ্বাসে বলে যাওয়ার পর এক সার সত্যি কথা বলে থামলেন, “বুঝলে বন্ধু, রাজা এতকিছু করলেন তাতে আমি একটুও নিরাশ হইনি। এটা তো আমাদের দরকার ছিল, নাহলে জাতি হিসেবে আমরা বাঁচবো কি করে? আজ যদি তোমরা ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাঙালিরা হঠাৎ নিজেদের দেশে ফিরে যাও, তাহলে তো আমরা শেষ হয়ে যাবো, আমাদের দেশটাই বন্ধ হয়ে যাবে!”

সৌদির চিঠি: কোম্পানি ছেড়ে দুবাই পালালো বস! (পর্ব ১১)

Leave a comment
scroll to top