সৌদির চিঠি, ঘরের থেকে এত দূরে দেশের দুঃসংবাদ এলে শান্ত হয়ে বসে থাকা কঠিন,পর্ব-৫
অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেল জাভেদের(নাম পরিবর্তিত)! ১৭ই জুন, এখন মাঝরাত, যখন লিখছি তখন প্রায় দুটো বাজছে । সবে ফিরলাম হাসপাতাল থেকে, কয়েকজন ওর সাথে থেকে গেল। বাংলাদেশের সাগরদীঘির জোয়ান ছেলে, এক মাসও হয়নি নতুন বাইক নেওয়ার, তার মধ্যেই এই দুর্ঘটনা। শুনছি ওরই নাকি দোষ, বেকায়দায় ওভারটেক করতে গিয়ে এই অবস্থা। অন্য গাড়িটি চালাচ্ছিলেন জনৈক সৌদির ব্যাক্তি, তিনি এখন থানায়, খুব শিঘ্রই নিজেরা বোঝাপড়া করে নিতে পারবেন। যদি সত্যিই জাভেদেরই দোষ হয়, তাহলে ভোগান্তি শুরু হলো… হাসপাতালে ওর চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারছি যে ওর বাঁ পায়ের গোড়ালি সেরে ওঠার থেকে অনেক বেশি চিন্তা আগামী টাকা পয়সার ভোগান্তি গুলোর জন্য। চোট যথেষ্ট গুরুতর, আমার আন্দাজ অন্তত দুই মাস বেডরেস্ট, কিন্তু তার মানে দুই মাস বিনা বেতনেও কাটাতে হবে যা বুঝলাম।
ব্যাপারটা একটু খোলসা করেই বলা যাক না হয়। এখানে অনেক প্রবাসী, বিশেষ করে বাংলাদেশিরা কম মাইনে হলেও নিজেদের শখ মেটানোর জন্য পুরোনো গাড়ি অথবা একটা নতুন বাইক কিস্তিতে কিনে নেয়, তারপর সেটাকে ব্যবহার করে নিজেদের জন্য সাইডে একটু টাকা আয়ের জন্য। হয়তো গাড়িটা ট্যাক্সি হিসেবে চালিয়ে, নাহলে বাইকে করে বিভিন্ন খাবার ডেলিভারি সংস্থার চালক হিসেবে। নিজের আসল কর্মক্ষেত্র তো থাকলোই কিন্তু সেই স্বল্প মাইনের সাথে সাথে আরেকটু যাতে দেশে পাঠানো যায়, সেই আশায়।
প্রতি মূহুর্তে মিডল ইস্টে যেকোনো বাংলাদেশির মুখে এখন এক কথা – “খুব শিঘ্রই দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে, আমাগো বাসায় এমনি বাজার করতেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে”। এই পরিস্থিতিতে এরকম “সাইড হাসল” একদমই অস্বাভাবিক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের এক সিনিয়র পড়াশোনা করতে গিয়ে জানাচ্ছে যে দুটো পার্ট টাইম জব করেও ঘর ভাড়া কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ইউরোপ, আমেরিকা, চারিদিকে খেটে খাওয়া মানুষের এখন এই হাল, সে আমরা স্বচক্ষে দেখছি। নিজেদের দেশেও যে এরকম পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই এসে উপস্থিত, সে আন্দাজ করা খুব একটা কঠিন নয়। তাই সৌদি তে কোম্পানির ভিসায় থাকাকালীন দ্বিতীয় কোনো মাধ্যমে টাকা আয় করা বেআইনি হলেও, কেউ খুব একটা কিছু বলতো না, যতক্ষন না আপনার দ্বিতীয় কাজের জন্য আপনার মূল কাজ অথবা কোম্পানির কাজে কোনো ক্ষতি হচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে অনেক দেশের কর্পোরেট এই ধরনের “মুনলাইটিং”(অর্থাৎ দিনের কাজ সেরে রাতে দ্বিতীয় কোনো কাজ ধরা) একেবারেই বরদাস্ত করেনা, সঙ্গে সঙ্গে ছাঁটাই করে দেয়। এই মুনলাইটিং শব্দটির প্রচলন বেড়েছিল প্যান্ডেমিকের সময়ে,যখন অনেক হোয়াইট কলার শ্রমিক ঘরে বসে একাধিক চাকরি শুরু করেছিলেন নিজেদের কম্পিউটার থেকে। তা যাই হোক, এবার আমাদের জাভেদ-দের কথায় ফেরত আসা যাক।
জাভেদের আগে আমাদের কোম্পানিতে আরো দুইজন বাংলাদেশী বাইক কিনে ফুড ডেলিভারি রাইডারের কাজ শুরু করেছিল। ৮-৯ ঘন্টা হোটেলে কাজ করে প্রায় আরও ৮ ঘন্টা রাইডার হিসেবে আয় মোটামুটি ভালোই হচ্ছিলো, বাইকের কিস্তি ঠিকঠাকভাবে মেটানো যাচ্ছিল। কিন্তু সৌদিতে কঠোর ট্র্যাফিক কানুন ব্যবস্থা থাকলেও অ্যাক্সিডেন্ট কম হয়না। এখানে রাস্তায় মানুষকে হাঁটতে খুব কমই দেখা যায়, সারা দিনরাত শুধু দ্রুত গতিতে গাড়ির আওয়াজ। ভারতের থেকেও লম্বা ট্র্যাফিক জ্যাম লাগা সত্ত্বেও, অনেক তাড়াতাড়ি তা ছেড়ে দেয়, উন্নত ট্র্যাফিক ব্যাবস্থা এবং জনতার সচেতনতার জন্য। তবুও অ্যাক্সিডেন্ট লেগেই থাকে।
জাভেদ প্রায় ১০ হাজার রিয়াল, অর্থাৎ লক্ষ দুয়েক বাংলাদেশী টাকা দিয়ে বাইক কিনেছিল। এমনকি দেশ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল এই উদ্দেশ্যে, এক মাসও হয়নি বলতে গেলে। বাড়িতে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে এই “ইনভেস্টমেন্ট” টা করলে আখেরে লাভ আসবে, তাই প্রতি মাসে ২০ হাজার বাংলাদেশী টাকার কিস্তি মেটানো নিয়ে আর বেশি ভাবনাচিন্তা করেনি। এবার এই দুর্ঘটনার পর শুধু ওর একার নয়, আমাদের সবার চিন্তা আর্থিক দিক দিয়েই। ওর ম্যানেজার কাল মধ্যরাতে হাসপাতালে দাঁড়িয়ে সাফ জানিয়ে দিল যে যেহেতু ডিউটির সময়ে অথবা কোম্পানির কাজে দুর্ঘটনা নয় তাই কোম্পানি চিকিৎসার খরচা বহন করবে না। বিফলে দুটো হাসপাতাল ওকে নিয়ে ঘুরলাম ওর মেডিকেল ইনসিওরেন্স যদি সেখানে কার্যকরী হয় সেই আশায়। দ্বিতীয় হাসপাতালে, যেখানে আমি নিজে আমার ইনসিওরেন্স খাটিয়েছি, সেখানে তাজ্জব ভাবে জানালো যে সেদিন রাত ১২টা থেকেই নাকি ইনসিওরেন্স বন্ধ হয়ে গেছে! বেশ অদ্ভুত ব্যাপার বলতে হবে…
এই ধরনের অ্যাক্সিডেন্ট হলে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে যদি কোন সৌদি ব্যাক্তির পরিবহনের সাথে কোনো গরীব ভারতীয়, বাংলাদেশি অথবা পাকিস্তানির গাড়ির টক্কর লাগে, তাহলে সেই ব্যক্তি দয়া করে এমনিই ছেড়ে দেয়, পুলিশ অবধি আর যায় না। শুধু ইনসিওরেন্সের ব্যাপারটা মিটে গেলেই হলো, যা অনেক দ্রুত মিটেও যায় দুই পক্ষের উদ্যোগে। একবার আমার সাথে এমন এক ঘটনা ঘটেছিল যা জীবনে ভুলবো না। গলি রাস্তায় জল জমে ছিল, আমি সেখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে একটি গাড়ি পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে ভুল করে একটু জল ছিটিয়ে দিয়েছিল। আমি ভারতে এই ব্যাপারে অভ্যস্ত বলে কিছু মনে না করে এগিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ গাড়িচালক গাড়ি থামিয়ে নেমে এলো। আমি অবাক, ভাবছি আমিই কোনও ভুল করলাম কিনা। উনি বারবার করে আরবিতে ক্ষমা চাইতে লাগলেন! ভারতে এই ধরনের ঘটনায় সচরাচর ঝামেলা মারপিটে অভ্যস্ত হয়ে এইরকম ব্যবহারের কি জবাব দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না!
এই কারনেই জাভেদের জন্য দুঃশ্চিন্তা এখন সবার মধ্যেই, ওর চোট নিয়ে নয়, বরং ক্যামেরায় ওরই দোষ ধরা পড়বে ওর বেকায়দা চালানোর জন্য, এবং ওর যে এত দেনা জমে যাবে দেশে বিদেশে সেই নিয়েও। মোটামুটি এই দুই মাস যে মাইনে আসবেই না, সে নিয়ে আর না হয় মাথা নাই বা ঘামালাম…