সৌদির চিঠি; পালানোর বোকামিটা করেই ফেললো আসানসোলের ছেলেটা, পর্ব-৪
সবার মুখে মুখে এখন ওড়িশা। সৌদিতে আমার সাথে যত ভারতীয়, পাকিস্তানি শ্রমিকের দেখা হচ্ছে সবাই শুধু ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়েই বিচলিত। ঘরের থেকে এত দূরে থেকে দেশের এমন দুঃসংবাদ এলে শান্ত হয়ে বসে থাকা খুব কঠিন। সেদিন কাজে যাওয়ার সময়ে এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল যখন, তখন সবাই আগে সবাইকে জিগ্যেস করছে পরিবারের কারুর কিছু হয়নি তো? সমস্ত ভারতীয় শ্রমিকদের একই উত্তর – যাঁরা গেছেন, তাঁরা আমাদেরই কাছের মানুষ ছিলেন। কতজন তো আবার এর মধ্যেও চক্রান্ত খুঁজছেন।
গাজিয়াবাদের ইরফান(নাম পরিবর্তিত) অনেক বছর আগে, ১৯৯৫ – এর মগধ ট্রেন দুর্ঘটনা নিজের গ্রামে থাকতে দেখেছিলেন। তখন তিনি স্কুলছাত্র। গ্রামবাসীদের সাথে দুর্ঘটনা স্থানে পৌঁছাতেই পুলিশ নাকি লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল। সেইদিন তিনি নরকের এক জ্বলন্ত চিত্র দেখেছিলেন নিজের চোখে। এখন তিন সন্তানের পিতা, মধ্যবয়স্ক ইরফান করুণ গলায় নিজের ছেলেবেলার এই গল্প শোনালেন সেই গ্রামের এত দূরে বসে, যখন নাকি এত পরিমাণে লাশ ওঠানো হয়েছিল, যে আজও তার কোনও হিসেব নেই। ওনার কথা গুলো শুনলে গায়ে কাঁটা দেয় – “পরিবার সহ রিজার্ভ করা ভালো ঘরের যত প্যাসেঞ্জারের লাশ ছিল তাঁদের তো হিসেব হয়ে যায়, যত গরিব, বিনা পরিবার মানুষ এদিক ওদিক ছিটকে ছিল তাঁদের বস্তার মত ট্রাকে তুলে নদীতে অথবা যেখানে সুবিধা সেখানেই ফেলে এলো, সব নিজের চোখে দেখা ভাই… এইজন্যই তো পুলিশ তাড়িয়ে দিল!” ১০ বছরের ওপর সৌদি আরবে কাটিয়ে এখন দেশে ফেরার জন্য দিন গুনছেন আর ৩ মাস ধরে মাইনের অপেক্ষা করছেন।
এখানে অনেক ভারতীয় বাঙালি শ্রমিক ঘরের এত দূরে থেকে আশঙ্কা করছেন যে এর পেছনেও কোনো নোংরা গল্প আছে কিনা। “আরে খেয়াল করে দেখো না, দুটো গাড়ি জুড়েই তো বাঙালি ছিল শুধু। বেশিরভাগ তো আমাদের রাজ্য থেকেই গেছে…”, এক নিশ্বাসে বলে গেল শান্তিপুরের আশীষ(নাম পরিবর্তিত)। সবে বিয়ে করা আমারই বয়সী ছেলেটি নিজের ছোট ভাইয়ের মতো দেখভাল করে আমার।
ওদিকে উত্তরাখণ্ডের প্রবীন(নাম পরিবর্তিত) হাসতে হাসতে এক অদ্ভুত ঘটনা শোনালো, যে এই ট্রেন দুর্ঘটনায় নাকি মর্গ থেকে কোনও মৃত ব্যক্তি নাকি নিজে থেকেই উঠে হাসপাতাল পৌঁছে গেছেন! উদ্ধারকর্মীরা তাড়াহুড়ো তে ভুলবশত ওনাকে হয়তো মৃত মনে করে মর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে জানত গেল তিনি আসলে জীবিত। “কৈসি খবরে আতি হ্যায় ইয়ার!” প্রবীন নিজের ফোনে নিউজ ফিড নিয়ে হাসতে হাসতে বললো। আজকাল শ্রমিকদের কেউ যতই নিরক্ষর মনে করুক, আশেপাশের খবরাখবর যোগাড় করা তাঁদের থেকে ভালো কেউ পারে না। বিশেষ করে যখন এতদূর বিদেশে ঘর পরিবার ছেড়ে এরকম বছরের পর বছর থাকতে হয়, তখন কিভাবে সংগঠিত হয়ে থাকতে হয়, কিভাবে নিজেদের সুবিধার্থে নেটওয়ার্ক তৈরি করে নিতে হয়, সেটা সত্যিই শেখার মত। স্মার্টফোন এসে আরো সুবিধা করে দিয়েছে – বাংলাদেশের একেবারে নিরক্ষর শ্রমিক থেকে শুরু করে সিরিয়া লেবাননের সিনিয়র, সবাই আমার থেকে জেনে নিয়েছে, নিজের ফোনে কোন সাইট অথবা অ্যাপের মাধ্যমে ইংরেজি শেখা যায়। এখন প্রায়সময়ই দেখি, যেকোনো কোথাও কাজের ফাঁকে কেউ হয়তো টুক করে একটু আধটু ইংরেজির ভিডিও দেখা অথবা একটা লেসন শেষ করে নিচ্ছে। শেখার উদ্যোগ, জানার খিদে দেখে মনে হয়, কীই বা করলাম নিজের ছাত্রজীবনে!
এই ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া তে অত গরীবের বেনামী লাশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মনে পড়লো, এই দুদিন আগে আনিস বলছিল দুবাইতে কাজ করা নিয়ে। বলছিল, সৌদি আর দুবাইয়ে শ্রমিকদের অবস্থার মধ্যে নাকি অনেক ফারাক। দুবাইতে নাকি তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা, যেকোনো সময়ে কর্মচারীর কাজ পছন্দ না হলে ফেরত যেতে পারে। কিন্তু সৌদি তে শ্রমিকরা ফেঁসে যায় মালিক আর দালালদের হাতে। এমন সময়ে আমরা মকতব-এ-আমল, অর্থাৎ লেবার কোর্টের দ্বারস্থ হতেই পারি। সেখানে সেই শ্রমিক এবং মালিক অথবা দালাল কে হাজির হতেই হবে, এবং এখনও অবধি আমার সাথে আলাপ হওয়া সমস্ত ব্যাক্তি জানিয়েছেন যে এই ব্যবস্থা সবসময় কার্যকরী হতে বাধ্য।
আজ অবধি সবসময়ই নাকি শ্রমিকের পক্ষে রায় বেরিয়েছে, এমনকি বহু ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ বাধ্য হয়েছে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে জরিমানা দিতে। এটা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণটা আনিস নিজেই বুঝিয়ে দিল – “একটা কথা মনে রেখো ভাই, লেবার আর মালিক দাঁড়ালে তাদের মধ্যে মালিকই মিথ্যা বলবে। তার নিজের স্বার্থ অনেক। কিন্তু একটা লেবার কখনো মিথ্যা বলেনা, আমার এই কথা তুমি মিলিয়ে নিও… একটা লেবারের স্বার্থ বলে কিছু নেই, তার চাহিদাও কম, সে শুধু তার হক বুঝে নিতে আসে। কিন্তু মালিক কখনোই তা নয়। তাই মনে রাখবে ভাই সব সময়, একটা শ্রমিক কখনো মিথ্যা বলেনা।“