সিনেমা মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে, তাকে সিনেমার মতো কাজ করতে বাধ্য করে। তাই সিনেমার যুক্তিগ্রাহ্যতা আর দায়বদ্ধতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূল স্রোতের বলিউডি অর্থকরী সিনেমায় লজিক খোঁজার সার্চ ইঞ্জিন অনেক আগেই ঝুলে গিয়েছে। দায়বদ্ধতারও সীমা-পরিসীমা ত্যাগ করেছে সফল কমার্শিয়াল। কিন্তু আর কী কী হারিয়েছে সিনেমা? নয়া রেকর্ড তৈরি করে বক্স অফিস কাঁপানো ‘অ্যানিম্যাল’ কী বার্তা নিয়ে এল?
আলফা মেল না বিকারগ্রস্থ?
ভারতের যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির মূলধারার ছবিতে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির বিপজ্জনক বাহাদুরী আজ নতুন নয়। কিন্তু অ্যানিম্যাল এই বিষাক্ততার মাত্রাকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। যেমনটা সিনেমার মুখ্য অভিনেতা রনবীর কাপুর ট্রেলার লঞ্চের সময় বলেছিলেন, “অ্যাডাল্ট রেটেড কভি খুশি কাভি গ়ম”। আরও ভালো করে বলতে গেলে, মনস্তাত্ত্বিক উপস্থাপনার দিক থেকে একে কভি খুশি কভি গ়ম এবং বাগ়বান-এর পিতাকেন্দ্রীক নিরাপত্তাহীনতার চূড়ান্ত কম্পাইলেশন বলা যায়। অন্যদিকে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির দিক থেকে অ্যানিম্যাল কবির সিং-এরও এককাঠি বেশি। বাচ্চা ছেলের হাত-পা ছোঁড়ার মতো যুক্তিহীন বাড়াবাড়ি যে-কোনও দর্শকের পক্ষেই বসে বসে দেখাটা বেশ অস্বস্তিকর।
পরিচালক সন্দীপ দেখিয়েছেন বাবার প্রতি নায়কের উদগ্র প্রেম এতটাই চরম পর্যায়ে যেতে পারে যে, প্রস্রাব করার সময় বাবা কোন হাতে লিঙ্গ ধরে আছে সেটাও ছেলে জানে এবং সেটাকেই ভালোবাসার চিহ্ন স্বরূপ ধরে নেয়। নিজের বাবাকে সুপারহিরোর তকমা দিয়ে তাঁকে বাঁচাতে দুনিয়া জোড়া বাঁদরামি সার্কাস হতে পারে, সিনেমা নয়।
অ্যানিম্যাল-এর অলংকার নারীবিদ্বেষী চাটনি
প্রসঙ্গত প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষ এই সিনেমার অন্যতম চাটনি। গোটা সিনেমা জুড়ে মনে হয়েছে দর্শককে যেন জোর করে শেখানো হচ্ছে, “দেখো, তুমিও এতটা নারীবিদ্বেষী হতে পারো, হলেই তুমিও পুরুষ; নাহলে নয়”। এখানে ‘অবৈধ’ প্রেমিকাকেও প্রেমের প্রমাণ দিতে হয় জুতো চাটার মাধ্যমে। যদিও শেষ পর্যন্ত জুতোটা চাটানো হয়নি। তারপরও এই প্রেমিকার প্রেমে কিন্তু কোনও খাদ মেশেনা। অর্থাৎ বোঝানো হয় পুরুষ যতই সহিংস হোক না কেন, শুধু পকেট আর বিছানা গরম থাকলেই তার সাথে প্রেম করা যায়।
কিন্তু এর সাথেই উপরি পাওনা হিসেবে যেটা জুড়েছে তা হল নারীর মাধ্যমেই নারীবিদ্বেষের সোশ্যাল ভ্যালিডেশন। যৌনতায় ম্যানিপুলেশন থেকে সফ্ট বিডিএসএম-এর সাথেই যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল একজন আস্ফালনকারী পুরুষকে ছদ্ম প্রগতিশীল প্রমাণ করার চেষ্টায় তার নারীবিদ্বেষকে আড়াল করা, যেটা করছে তার স্ত্রী স্বয়ং। এই যেমন ছবির দ্বিতীয়ার্ধে প্রধান নারী চরিত্র হিসেবে রশ্মিকার একটি ডায়লগ উল্লেখ করা যায়, যেখানে রশ্মিকা বলছে তার ‘স্বামী’ প্রসবের সময় তাকে সাহায্য করেছে এবং কোনও ‘অভিযোগ’ও করেনি তাই তার বিষয়ে রশ্মিকার বাবা-মায়ের কোনও চিন্তা থাকার কথা নয়।
অন্যদিকে অত্যন্ত নারীবিদ্বেষী একজন পুরুষের আকর্ষণের বস্তু হিসেবে একজন ‘ভোকাল’ মেয়েকে দর্শিয়ে সামাজিকভাবে নারীর প্রতিবাদ চেতনাকে পৌরষের ললিপপ হিসেবেই এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা যথেষ্ট অবমাননাকর। এছাড়াও অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করা এবং স্ত্রীর কাছে তা ঘোষণা করে জায়েজ করে তোলার প্রক্রিয়াও বেশ অস্বাস্থ্যকর মানসিকার ছাপ ফেলে। জঘন্য, উগ্র পৌরুষের আস্ফালন সহ প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষী শক্তি ও সংস্কৃতি ভারতের সমাজ রাজনীতির একটি অংশে বহু বছর ধরেই অতিসক্রিয়। বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যেও এই মুহূর্তে ব্যাপারটা বেশ খাপ খেয়েছে। লুকিয়ে চুরিয়ে ব্যাপারটা আগেই ছিল কিন্তু বর্তমানে প্রকাশ্যে তা তুলে ধরার উদগ্র প্রচেষ্টাও বাঙালি পুরুষের একটা ক্যারেক্টার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সিনেমা তাই বাঙালি সমাজেও এই মানসিকতা উসকে দিতে বেশ সহায়ক হবে।
তাছাড়া ছবির পড়ৎ-এ পড়ৎ-এ এমন অনেকই মালমশলা রয়েছে যা ফ্যাসিবাদী প্রোপাগান্ডাকে চটপটির মতো রোচক করতে বেশ উপযোগী হতেই পারে তা বলাই বাহুল্য। উদাহরণে প্রথমার্ধে স্বস্তিক চিহ্ন দেখানো ও কারখানার শ্রমিকদের মালিককে বাঁচানোর লড়াই করতে বলা এবং দ্বিতীয়ার্ধে হঠাৎ তার নাৎসিবাদের সঙ্গে সম্পর্কহীনতার প্রসঙ্গ তুলে একপ্রকার জোর করেই অহেতুক নায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করার মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যানিম্যাল-এ সংহিসতা বীভৎস নয় বরং বিরক্তিকর
এছাড়া এই সিনেমায় সহিংসতা প্রর্দশন অ্যানিম্যাল এডাল্ট রেটেড হওয়ার অন্যতম কারণ। যে কারণে ছবি প্রকাশ পাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই প্রচলিত সংবাদমাধ্যম সন্দীপ রেড্ডী ভাঙ্গাকে টারান্টিনোর সাথে তুলনা করতে উদ্ধত হয়েছিল। এর থেকে বেশি হাস্যকর যে কিছুই হতে পারেনা তা যারা দেখবে তারা বুঝবে। ভায়োলেন্স নিয়ে যে সমস্ত দুর্ধর্ষ সৃজনশীল কাজ এযাবৎ হয়েছে তার ধারেপাশে যায়না অ্যানিম্যালের ভায়োলেন্স। নিদেন পক্ষে ভারতীয় ওয়েব সিরিজের যুগে মানুষের জান্তব সত্বার যে দুরন্ত উপস্থাপনা নেট জগত কাঁপাচ্ছে, তার তুলনাতেও অ্যানিম্যাল অশাহত হওয়ার মতোই উপাদান। তাই বাছাই করা দক্ষিণী সিনেমার সৃজনশীল সহিংসতা দেখতে যারা অভ্যস্থ তাদের কাছে এই সিনেমা যথেষ্ঠ ম্যাড়ম্যাড়ে ঠেকবে।
গল্প কোথায়?
কিন্তু এসবই জানা কথা, বলা কথা। আলোচনার বিষয় হল সিনেমায় কী নেই। এই তিন ঘন্টা একুশ মিনিটের সিনেমায় পরিচালক সন্দীপ রেড্ডী ভাঙ্গা প্রেম, দাম্পত্য, অ্যাকশন, কেচ্ছা সবটাই রেখেছেন কিন্তু মোক্ষম উপাদানটাই মেশাতে ভুলে গিয়েছেন। গল্প। কবীর সিং-এর তুলনায় এর পৌরুষযাপনের পরিমাণ বাড়াবাড়ি রকমের বেশি হলেও, তার সাথে অ্যানিম্যালের একটা সাধারণ পার্থক্য হল কনটেক্সট। ড্যাডি ইস্যু শুধু একটা ভালো কনসেপ্টই নয় বরং ভারতীয় সমাজেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ জঞ্জালের দূর্গন্ধ। যেটা নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট জায়গা আছে। অন্ততঃ পিতার বাজে অভিভাবকত্ব কিভাবে ছেলেকে বিগড়ে দিতে পারে তার উপর ভিত্তি করে ভালো সাইকো-থ্রিলারও হতে পারে। যা হলে রনবীর কাপুর, অনিল কাপুর বা রশ্মিকা মণ্ডানার মতো প্রবাদপ্রতিম অভিনেতাদের প্রতিভাকেও ফুটিয়ে তোলা যেত। কিন্তু ভালো এডিটিং আর খাপছাড়া গল্পের গরুর গুঁতোয় সম্পর্কহীন অথচ ভালো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের তোড়ে সিনেমাটা নিজেই যেন খেই হারিয়ে ডুবে গেল। অভিনেতারা নিজের কাজ ফুটিয়ে তোলার সুযোগ পেলেন না। একটা ভালো গল্পের ক্রাইসিস কিছুতেই মেটানো গেল না। গল্পের ভিত্তিতে কবির সিং তাও পাতে দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচ্য হলেও অ্যানিম্যাল সেই জায়গাও তৈরি করতে পারেনি।
দুই চার কথায় এই লেখা শেষ করাই যেত, কিন্তু তিন ঘন্টা একুশ মিনিটের অসহ্যকর পরিবেশের তুলনায় লেখার আবেশটা ভালো। যাবজ্জীবনের বেশিটাই তো সিনেমাহলেই কেটে যায়। পরিশেষে, একটা সিনেমা যেটা ভালো হতে পারতো কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত পিতৃতান্ত্রিক পাকামি সেই সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়েছে। তার সাথেই প্রমাণ করেছে, পয়সা থাকলে আর ফেসভ্যালুওয়ালা অভিনেতাদের কিনতে পারলে স্রেফ তার দমেই একটা সিনেমা বিহীন সিনেমা বক্স অফিস ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে।