আজ ৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি নারী দিবস। পিতৃতান্ত্রিক চালু সমাজের ভাষায় অলক্ষ্মী দিবসও বলা চলে। কারণ, ‘লক্ষ্মীমন্ত বৌ-ঝিয়েরা তো এসব অধিকার ফলানো কথা বলে না। তারা থাকবে পুরুষ শাসিত সমাজের পায়ের তলায়।’ এমনতর কথা আমরা প্রায়শই শুনতে পাই। কখনও দেখতে পাই নারী দিবস-এর পাল্টা পুরুষ দিবসও। আজকাল নির্যাতিত পুরুষদের কান্নাকাটিও বেশ শোনা যায়। তাই এমন বিতর্কও ওঠে যে আদৌ দিনটির কোনও প্রয়োজন আছে কি না। কিন্তু প্রয়োজন আছে। কেন আছে তা নিয়েই এই লেখা।
আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি আগের কথা। ১৯০৯ শালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজপথ দখল করেছিল নারী শ্রমিকেরা। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতন্ত্রীরা নারী শ্রমিকদের নিয়ে ঢালাও সভার আয়োজন করেছিল সেই দেশে। দাবি শ্রমজীবী নারীর রাজনৈতিক অধিকার। সেই সময় বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ছিল না নারীর ভোটাধিকার। সমাজের অর্ধেকটা বাদ রেখে কিভাবে সমাজ চলবে তা ভাবনাতেই আসেনি নাকি তৎকালীন হত্তা-কত্তা-বিধাতাদের? নাকি এসেছিল মাথায় কিন্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি এতই প্রিয় তাই তার উপর অধিকার ফলানোই ছিল দস্তুর। তাকে সামান্যও মুক্ত করার জো ছিল না কারও। কিন্তু তখন এই দুঃসাহসী অলক্ষীরাই কিন্তু নিজের লড়াই লড়তে মাঠে নামে।
কেটে গেল এক বছর। ১৯১০ সালে শ্রমজীবী নারী আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠিত হল। সেখানে এই বিষয়টি উপস্থাপন করলেন জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন। বললেন আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি নারী দিবস উদযাপনের কথা। সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হল। সিদ্ধান্ত হল প্রতিবছর একই দিনে প্রতিটা দেশে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে পালিত হবে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি নারী দিবস। পরের বছর এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯১১ এবং ১৯১২ সালে ১৯শে মার্চ পালিত হয়েছিল এই দিন। পরে ১৯১৩ সাল থেকে বরাবরের মতো আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি নারী দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে ৮ই মার্চ।
প্রাথমিকভাবে মেয়েদের ভোটাধিকারের দাবি নিয়ে এই দিন উদযাপন করা শুরু হলেও পরে সমাজের অগ্রগতির সাথে সাথে দাবি হিসেবে যুক্ত হয় গার্হস্থ্য শ্রমের শ্রম হিসেবে মর্যাদা, নারীর প্রকৃত অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, বেকারত্ব হ্রাস, মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি শ্রম সংক্রান্ত দাবি। ১৯৭৫ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ৮ই মার্চ তারিখটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস বলে স্বীকৃতি দেয়। রাতারাতি উবে যায় শ্রমজীবী মর্মবস্তু। ধীরে ধীরে আমদানি হয় অ-শ্রমজীবী, পণ্যবাদী, ভোগবাদী তত্ত্বের। নারী দিবস তাই ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে শ্রমজীবি নারীদের দাবিগুলির থেকে এবং রঙচঙে বিজ্ঞাপনচিত্রের অনেকটাই কাছে চলে যায়। এই হিসেবে বলা যায় প্রথম থেকেই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি নারী দিবস মূলত কথা বলেছিল বর্তমান নারী দিবসের এই পণ্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই।
মোদ্দা কথা ব্যাপারটা শুধু নারী দিবস নয়, বরং শ্রমজীবী নারী দিবস। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই দিন উযাপনের লক্ষ্য ছিল নারীদের অর্থনৈতিক এবং অবশ্যই রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। ইদানিং সেই লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে? এখানেই আসে দিনটির তাৎপর্য। চলে আসি একবিংশ শতাব্দীতে। একবার পশ্চিমের উন্নত এবং বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাবশালী দেশগুলির অর্থনীতির উপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। স্ট্যাটিস্টা অনুযায়ী, গত ২০২৩ সালেও আমেরিকার কর্মরত নারীর হার ছিল মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৫৫.৪ শতাংশ যা ২০০০ সালের ৫৭.৫ শতাংশের থেকে কমেছে। আমেরিকায় এখনও নারী ও পুরুষের সমকাজে সমবেতন প্রদান করা হয় না। এমনকি যে কর্মক্ষেত্র নারী প্রধান, সেখানেও পুরুষেরাই বেশি উপার্জন করেন।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের সাধারণ সভার তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাজ্যে কর্মরত নারীর হার ৭২.১ শতাংশ যা ২০১৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ ফেব্রুয়ারির হার ৭২.৪ শতাংশ থেকে কমেছে। ওই একই সময় পুরুষদের অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ ছিল ৭৮.১ শতাংশ। বেতনের ক্ষেত্রে স্থায়ী নারী কর্মীদের বেতন গড়ে সাপ্তাহিক ৬২৯ পাউন্ড, ওই একই হিসেবে স্থায়ী পুরুষ কর্মীরা পান ৭২৫ পাউন্ড। অর্থাৎ পার্থক্য ৯৬ পাউন্ড! যা ভারতীয় টাকার হিসাবে ১০২০৬.২৫ টাকা। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি নারী কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেন সলোমন দ্বীপপুঞ্জে যার হার ৮৪.২%। ভারতে এই হার ২৯.৯ শতাংশ।
ভারতের কথা নির্দিষ্ট করে বললে, ভারতে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের হার গড়ে ৩৭ শতাংশ, যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার ৭৮.৫ শতাংশ। গ্রাম্য অঞ্চলে ৪১.৫ শতাংশ নারী কর্মরত এবং শহরে ২৫.৪ শতাংশ নারী কর্মরত। এছাড়াও জানা যায় যে ভারতের ৭৮ শতাংশ কর্মরত নারীই কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত। বার্ষিক পর্যায়ক্রমিক শ্রম শক্তি সমীক্ষা, ২০২১-২০২২ অনুসারে, কৃষিতে সর্বাধিক আনুমানিক নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ৬২.৯ শতাংশ। ভারতের গ্রামীণ মহিলারা বহু বছর ধরে এই সেক্টরে অবদান রাখছে, তবে বেশিরভাগই তাদের নিজস্ব খামারে শ্রমিক হিসাবে, “কৃষক” হিসেবে নয়। ভারতীয় কৃষক হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী কৃষকদের গ্রাহ্যই করা হয় না।
ভারতের কৃষি ক্ষেত্র অনিয়মিত ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ, কোনও নির্দিষ্ট সংগঠিত সংস্থার আওতায় এই ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রিত হয় না। অর্থাৎ এটি অসংগঠিত ক্ষেত্র। যেহেতু ভারতের অধিকাংশ কর্মরত নারীই কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত তাই তারাও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। ভারতে অসংগঠিত শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে আলাদা করে আইন থাকলেও সেখানে নারীদের নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা প্রয়োজন কারণ, ভারতের কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত নারীদের প্রায় সবটাই নিজগৃহে বিনাপয়সার গৃহশ্রমিকও বটে। অথচ, কর্তব্যের নামে এই শ্রমের কোনো সামাজিক স্বীকৃতি পর্যন্ত নেই। তাছাড়া রয়েছে গর্ভধারণ ও মাতৃত্বের প্রশ্ন।
একথা অজানা নয় যে কৃষিজমির কীটনাশক সরাসরি নারীর গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও রয়েছে পেশা সঙ্ক্রান্ত রোগ এবং অপুষ্টির মতো গভীর সমস্যা। তাছাড়া আয় বৈষম্য তো রয়েইছে। এখনও ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে বাইরে থেকে ক্ষেতমজুর নিয়ে আসা হয় এবং তাদের জরায়ু অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হয় যাতে নারী শ্রমিকদের মাসিক কালীন ছুটি না দিতে হয়। উপরন্তু অস্ত্রোপচারের টাকা দেয় জমির মালিক বা নিয়োগকারী ঠিকাদার, ফলে দীর্ঘদিন কার্যত বেগার খেটেই শোধ করতে হয় ঋণ।
মেয়েদের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে বাড়ছে নারী নির্যাতনও। দেশে নারী নির্যাতন বেড়েছে ৪%। রাজ্য পণের দায়ে বধু হত্যায় শীর্ষে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান না করে নারী অধিকার অর্জন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সমগ্র মানবজাতির মুক্তি। আর এই সবটা নিয়ে কথা তুলতে হলে ছাড়তে হবে ভান্ডারের ভরসায় লক্ষ্মী এবং বাধ্য হয়ে ওঠার তাড়না। কারণ রাজনৈতিক অধিকার না থাকলে কোনও সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। অধিকারের প্রশ্ন, মর্যাদার প্রশ্ন ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে অলক্ষ্মী যদি হতেই হয়, দোষ কি তাতে?