সিদ্দিক কাপ্পান একজন কেরালার সাংবাদিক। ২০২১ সালে হাথরাস কান্ডের সাংবাদিকতা করতে যাওয়ার সময় উত্তর প্রদেশ পুলিশ তাকে আটক করে। দুই বছর চার মাসের কারাবাস, তারপর প্রথম অনুষ্ঠানে কলকাতায় এলেন কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান। গত রবিবার ১৬ই জুন দক্ষিণ কলকাতার সুজাতা সদনে পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভ আয়োজিত আলোচনা সভায় ‘আজকের ভারতের সাংবাদিকতা’ নিয়ে বক্তব্য রাখলেন সিদ্দিক কাপ্পান।
আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথাগত সাংবাদিকতার সমালোচনা করে সিদ্দিক কাপ্পান বললেন, “ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সাইডস্ট্রিম মিডিয়া হয়ে গিয়েছে মূলস্রোতের মিডিয়ার কাজ কি? পিআর বানানো। একটা মেইনস্ট্রিম মিডিয়া চালাতে গেলে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন। বিজ্ঞাপন ছাড়া প্রিন্ট বা ডিজিটাল মিডিয়া চলবে না, আর বিজ্ঞাপনের জন্য চাই পিআর। ক্ষমতাশীল সরকার এই সংস্থাগুলিকে পিআর সরবরাহ করে… যদিও কিছু ব্যতিক্রম আছে কিন্তু তাদের আক্রমণ করে সরকার। আমরা জানি NDTV-র সাথে কি হয়েছে গত বছর পর্যন্তো NDTV এমনই এক ব্যতিক্রমী মিডিয়া ছিল বর্তমানে তা পুরোদস্তুর কর্পোরেট মিডিয়া হয়ে উঠেছে।”
মিডিয়ার সাংবাদিকতা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, “এখন অল্টারনেটিভ মিডিয়াকে মানুষ সাহায্য করলে কিছু হবে; না হলে ভারত, মায়ানমার বা আফগানিস্তানে পরিণত হবে।”
সাংবাদিকদের উপর ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় আক্রমণ নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, “আমরা একটি অঘোষিত জরুরি অবস্থার মধ্যে রয়েছি। কেবল ২০২২ সালেই ৯২ জন সাংবাদিক রাষ্ট্রীয় আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। কাশ্মীরি সাংবাদিক ও ছবি সাংবাদিকরা গ্রেফতার হচ্ছেন।… ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের জোট বাঁধতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র আমাদের স্মৃতি। আমাদের প্রতিটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আমরা যদি ভুলে যাই তাহলে ফ্যাসিবাদ আবার মিথ্যে কথা বলবে। মিথ্যাবাদীতা ফ্যাসিবাদের একটি প্রবণতা।”
সদ্য জামিন প্রাপ্ত কাপ্পানকে তার স্ত্রী রোহানা বিপদের আশঙ্কায় এতটা পথ একা ছাড়তে রাজি হননি। রবিবারের কলকাতার এই সভায় তাই উপস্থিত ছিলেন রোহানা সিদ্দিকী। তার বক্তব্য গুলোর তরজমা কাপ্পান নিজেই করেছেন। রোহানার কথায়, “কাপ্পানের মা অসুস্থ; ৯০ ছুঁই ছুঁই। বাচ্চারা অপ্রাপ্তবয়স্ক। কাঁদলে কি করে ইনসাফ আসবে?” সিদ্দিক কাপ্পান কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, “রোহানা হিন্দি বা ইংরেজি বলতে পারে না। ওঁর মত ঘরোয়া মেয়ের সুপ্রিম কোর্ট থেকে লখনৌ জেলে ছোটা ছুটি সোজা ছিল না। ওর লড়াই আমার থেকেও কঠিন ছিল।” হাথরাস প্রসঙ্গে সিদ্দিক কাপ্পানের সাংবাদিকতা করতে যাওয়া নিয়ে রোহানা বলেছেন, “আমিও তো মেয়ের মা, তাই কিভাবে চুপ থাকতাম!”
তার হেফাজতকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেছেন, “পুলিশ আমায় প্রশ্ন করেছিল আমি কি পাকিস্থানে গিয়েছি? আমি কি বিফ খাই? আমি সিপিএম না মাওবাদী?… লখনৌয়ের জঙ্গি দমন পুলিশ থেকে সেনা প্রথম দিনই আমাকে জেরা করে। সময় পুলিশ প্রথম দিন আমাকে চড় থাপ্পড় মেরেছিল। এরপর জেলতো মানসিক নির্যাতনের আখড়া। জেলে চাইলে গাজা সিগারেটও পাওয়া যায়। কিন্তু বইপত্র পাওয়া যায় না। কারণ ওদের কাছে বইপত্র আরও অনেক বেশি ভয়ানক।… জেলে ৪৫ দিন থাকার পর আমি বাড়ির লোকের সাথে কথা বলার সুযোগ পাই। কিন্তু জেল থেকে পরিষ্কার জানানো হয় যে কেবলমাত্র হিন্দিতে কথা বলা হবে মালায়ালাম বা ইংরেজি চলবে না।” সিদ্দিক জানিয়েছেন, আটক হওয়ার পর ২১ দিন তাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করার জন্য বরাদ্দ ছিল একটা বালতি।
আজকের ভারতের সাংবাদিকতার একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশ বাদে বাকি অংশের বিকিয়ে যাওয়া নিয়ে খুবই আক্ষেপ করেছেন সিদ্দিক কাপ্পান। ভারতের স্বাধীন স্বর, সুশীল সমাজের উপর আক্রমণের প্রতিবাদ করেছেন তিনি। আলোচনা সভায় কথা প্রসঙ্গে তুলে এনেছেন ভীমা করেগাঁও বন্দীদের কথা, জি.এন সাইবাবার কথা, গৌতম নাওয়ালখার কথা, গৌরী লঙ্কেশের কথা। ৪২ বছর বয়সী কাপ্পান বলেছেন, “আমার বিরুদ্ধে ইউএপিএ লাগু হয়েছে। ইডি আমার বিরুদ্ধে পিএমএলএ আইনে কেস দিয়েছে, এক বন্ধুর একাউন্টে মাত্র পাঁচহাজার টাকা পাঠানোর জন্য। এখন কে আমায় কাজ দেবে? কেন কাজ দেবে? কিছু নিকট বন্ধুদের সাহায্যে কিছু কাজ আমি করছি কিন্তু তিন সন্তানের পিতা হিসাবে তা যথেষ্ট নয়। কপিল সিবাল, আইবি সিং-এর মতো বহু আইনজীবী আমার কেস বিনামূল্যে লড়ে দিতে চেয়েছেন। না হলে মামলার ব্যয়ভার আমার পক্ষে বহন করা সম্ভব হতো না।”
এছাড়াও সিদ্দিক কাপ্পান বলেছেন, “প্রতি সোমবার আমায় মালাপ্পুরমের স্থানীয় থানায় হাজিরা দিতে যেতে হয়। তাছাড়া প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর আমাকে লখনৌ কোর্টে যেতে হয়। যেতে আসতে এক সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। এই জীবনকে কি আপনারা মুক্ত বলবেন? আমি একটি ‘ওপেন জেল’-এ আছি।”