প্রখ্যাত সোভিয়েত কথাসাহিত্যিক ও মার্কসবাদী রাজনৈতিক কর্মী ম্যাক্সিম গোর্কির ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কলকাতার রুশ দূতাবাসের বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গোর্কি সদনে এক সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সোমবার, ২৭শে মার্চ এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন কলকাতার রুশ কনসাল জেনারেলের বরিষ্ঠ কনসাল ও প্রটোকল অফিসার একাতেরিনা লাজারেভা। তাঁর সাথে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গোর্কি সদনের প্রধান সের্গেই সুশিন এবং অধ্যাপক সরসিজ সেনগুপ্ত। এই তিনজনই গোর্কির জীবন ও সাহিত্য কর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
এর সাথেই গোর্কির ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে লাজারেভা, সুশিন এবং সেনগুপ্ত উদ্বোধন করেন একটি ফটোগ্রাফি প্রদর্শনের যাতে গোর্কির জীবন, তাঁর সমসাময়িক কালের ঘটনাবলী ও তাঁর কর্মকান্ডের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রদর্শনীর একটি অন্যতম বিভাগ হল “ইন্ডিয়া কানেকশন” যাতে গোর্কির সাথে ভারতের তৎকালীন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের যোগাযোগ ও তিনি কী ভাবে সেই সময় ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-বিরোধী সংগ্রামে সহায়তা করেছিলেন, বিশেষ করে ম্যাডাম বিকাজী রুস্তম কামা’র সঙ্গে তাঁর পত্র মারফৎ যোগাযোগের ঘটনাবলী এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ, যিনি ম্যাক্সিম গোর্কি নামে বিশ্বে সুপরিচিত হন, ১৮৬৮ সালের ২৮শে মার্চ রাশিয়ার নিজনি নোভগোরোডে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সেই আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ তাঁর জাহাজ কর্মী বাবা কে হারান, এবং তাঁর মা অন্য কাউকে বিয়ে করে চলে যাওয়ায় নিজের ঠাকুর্দার কাছেই মানুষ হন তিনি। জার শাসনাধীন রাশিয়ায় নিজের সাহিত্য জীবন শুরু করার সময়েই আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ নিজের ছদ্দনাম নেন ম্যাক্সিম গোর্কি। “গোর্কি” কথাটার আক্ষরিক মানে হল “তেতো”, যা তিনি তৎকালীন সাহিত্যের জগতে চারপাশের সমাজের সঙ্কট কে তুলে ধরার জন্যে ব্যবহার করা শুরু করেন।
মাত্র ২৪ বছর বয়সে গোর্কির প্রথম কাহিনী প্রকাশিত হয় একটি সাময়িক পত্রিকায়। তারপরে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি, যদিও অনেক সঙ্কটে তাঁর জীবন কাটে। ১৮৯৮ সালে তাঁর প্রথম গল্প সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। এর পরে তিনি ধীরে ধীরে জার শাসিত রাশিয়ার বিপ্লবীদের ঘনিষ্ঠ হন ও বামপন্থায় আকৃষ্ট হন। গোর্কি ১৯০৫ সালের বিপ্লবে যোগদান করেন ও তারপরে তিনি রাশিয়া ছেড়ে লন্ডনে যান, যেখানে তাঁর পরিচয় রুশ বিপ্লবের নায়ক ও বলশেভিক নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সাথে হয়।
তাঁর অসংখ্য উপন্যাসের মধ্যে “মা” লেখাটি বিশেষ করে জনপ্রিয় হয় এবং এই উপন্যাসটি বিশ্বের ৪৪টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রাশিয়ায় উপন্যাসটি ৫৮টি ভাষায় প্রকাশিত হয়। রুশ বিপ্লবের পর থেকে নতুন সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থার এক অন্যতম বৌদ্ধিক কারিগর হয়ে ওঠেন। তিনি সারা বিশ্বে পরিচিত হন শ্রমিক শ্রেণীর নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক হিসাবে। ১৯৩৬ সালে গোর্কি সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর খবরে বিষাদের ছায়া নেমে আসে সারা বিশ্বের প্রগতিশীল সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী মহলে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসাবে গোর্কি সদনের তরফ থেকে গৌতম ঘোষ ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানালেন যে গোর্কির সাথে তৎকালীন সময়ের অবিভক্ত ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের পাঞ্জাবের লেখক সংঘেরও যোগাযোগ হয়েছিল এবং সেই সংঘের তরফ থেকে তাঁকে এই সংগঠনের উপদেষ্টা মণ্ডলীতে থাকার জন্যে অনুরোধ জানানো চিঠিও এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।
ঘোষ জানান, ৩১শে মার্চ অবধি এই প্রদর্শনী চলবে। মঙ্গলবার, ২৮শে মার্চ, গোর্কি সদনের রুশ ভাষার পড়ুয়ারা একটি অনুষ্ঠান করবেন। সেইদিন বিকেলেই কলকাতার সাহিত্যিকেরা একটি সাহিত্য সমাবেশের আয়োজন করেছেন প্রগতি সাহিত্য সংঘের ব্যানারে। তিনদিন ধরে গোর্কির কাহিনীর উপর নির্মিত তিনটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে সেভোলোদ পুদোভকিন নির্মিত গোর্কির বিখ্যাত “মা” উপন্যাসের উপর “মাদার” চলচ্চিত্রটি। ঘোষ জানান যে এই বছরেই পুদোভকিনের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী পালন হবে। এছাড়াও আকিরা কুরোসাওয়া নির্মিত “দ্যা লোওয়ার ডেপ্থ” এবং গ্লেব প্যানফিলভ পরিচালিত গোর্কির “ভাসা জেহেলেজনোভা” নাটক অবলম্বনে নির্মিত “ভাসা” সিনেমাটি প্রদর্শন করা হবে।
ঘোষ জানান যে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে গোর্কির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার এই সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান কলকাতার মানুষের ভাল লাগবে।