Close

পশ্চিমাদের দোষে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে অকাল শিশু মৃত্যু বাড়ছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোয়

পশ্চিমা, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর দোষে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের ফল ভোগ করছে নিম্ন আয়ের দেশগুলো যেখানে অকাল শিশু মৃত্যু বেড়ে চলেছে।

পশ্চিমাদের দোষে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে অকাল শিশু মৃত্যু বাড়ছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোয়

সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে শিশুদের অকাল মৃত্যু নিয়ে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে জাতি সংঘ। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে বায়ু দূষণের কারণে ৯১% অকাল শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, যদিও জলবায়ু পরিবর্তন পশ্চিমা, উচ্চ আয়ের দেশগুলির কারণে ঘটছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), ইউনিসেফ এবং পার্টনারশিপ ফর ম্যাটারনাল নিউ বর্ন অ্যান্ড চাইল্ড হেলথের (পিএমএনবিসিএইচ) সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে গর্ভাবস্থার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের অগণিত প্রভাব—প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ—আলোকপাত করেছে যার ফলে মৃতপ্রসব, অকাল জন্ম এবং স্বল্পকালের জন্যে গর্ভবতী হওয়ার মতন প্রভৃতি ঘটনা ঘটছে ও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন—তাপ এক্সপোজার, ঝড়, বন্যা, খরা, দাবানল এবং বায়ু দূষণ— ও তার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, পানি বা খাদ্যবাহিত রোগ, ভেক্টর বাহিত রোগ, অভিবাসন, সংঘর্ষ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্থিতিস্থাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে একজন নারীর গর্ভাবস্থা প্রভাবিত হয়। যেহেতু এই ঝুঁকিগুলো পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ গোলার্ধের এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় বেশি, তাই এই দেশগুলোর নারীরা বেশি মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হতে পারেন এবং সন্তান ধারণ ও প্রসবের সময়ে নানা ধরণের সঙ্কটের সম্মুখীন হতে পারেন।

জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে মাতৃত্ব কালীন ঝুঁকি কমাতে এবং জলবায়ু জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় নীতি ও কর্মসূচি রূপায়ণের ক্ষেত্রে সরকারগুলোকে যেমন নারী ও শিশুর প্রতি গুরুত্ব বাড়াতে হবে তেমনি তাঁদের সুস্বাস্থের জন্য আরও জনকল্যাণমূলক লগ্নির প্রয়োজন। কারণ বায়ু দূষণ প্রতি বছর ৬০ লক্ষ অকাল জন্মে অবদান রাখে বলে আন্দাজ করা হচ্ছে। 

“আইপিসিসি এবং অন্যান্যদের সাম্প্রতিক গবেষণায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি একটি বহুমাত্রিক, গতিশীল ঘটনা যা প্রান্তিককরণের ঐতিহাসিক এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াকে একে অপরের সাথে যোগ করে তৈরি করা হয়েছে। যে সব সমাজে উচ্চস্তরের বৈষম্য রয়েছে সেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য স্থিতিশীল নয়”, লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন এর মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল ইউনিট দ্য গাম্বিয়ার ডাঃ আনা বনেল বলেছেন।

জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রসবকালীন সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিশ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে অকাল জন্মের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে বায়ু দূষণ হয় যা হাঁপানিতে আক্রান্ত মায়েদের ঝুঁকি ৫২% বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়াও চরম তাপের কারণে মায়েদের ঝুঁকি ১৬% বেড়ে যায় এবং অন্যান্য চরম আবহাওয়ার ঘটনা, যেমন খরা, প্রভৃতিও তাঁদের ঝুঁকি চরম ভাবে বৃদ্ধি করে।

“যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বের সব ক্ষেত্রেই অনুভূত হচ্ছে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা এই সংকটে সবচেয়ে কম অবদান রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাপী, বায়ু দূষণজনিত অকাল শিশুদের মৃত্যুর ৯১% ঘটনা নিম্ন এবং মধ্যম পর্যায়ের আয়ের দেশগুলিতে হয়, যেখানে উচ্চ আয়ের দেশগুলি জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে”, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

সাম্প্রতিক হিসাবে দেখা গেছে যে ঘরোয়া দূষণের কারণে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে, ১৫.৬% কম ওজনের শিশুর জন্ম হয় এবং ৩৫.৭% অকাল জন্ম হয়।

ডাঃ বনেলের নেতৃত্বে গাম্বিয়ার ৯২ জন গর্ভবতী মহিলার উপর করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে চরম দাবাদহের কারণে, প্রতি অতিরিক্ত ডিগ্রি সেলসিয়াস একটি ভ্রূণের উপর ১৭% চাপ বৃদ্ধি করে, বিশেষ করে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে এবং নাভির মাধ্যমে রক্ত প্রবাহকে ধীর করে দেয়।

অন্য একটি গবেষণায় ভারতের জেলা পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের মধ্যে একটি বড় মাত্রার সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, কারণ যেসব জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির উচ্চ মাত্রা রয়েছে সেখানে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব অনেক বেশি। 

“জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় পথের মাধ্যমে মহিলাদের গর্ভাবস্থাকে প্রভাবিত করে। সাধারণ প্রত্যক্ষ পথের মধ্যে রয়েছে তাপ এক্সপোজার, ঝড়, বন্যা, খরা, দাবানল এবং বায়ু দূষণ। পরোক্ষ পথের মধ্যে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, পানি বা খাদ্যবাহিত রোগ, ভেক্টর বাহিত রোগ, অভিবাসন, দ্বন্দ্ব এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্থিতিস্থাপকতা”, ডাঃ বনেল বলেছেন।

উল্লেখ্যযোগ্য হল, যে এই প্রতিবেদন দেখিয়েছে যে যদিও মাতৃ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিস্তর প্রমাণ বর্তমানে উপস্থিত রয়েছে, তবুও এই নিয়ে রাজনৈতিক স্তরে কোনো বিশেষ চাপানউতোর নেই, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। অন্যদিকে উচ্চ আয়ের দেশগুলো এই সমস্যার স্রষ্টা হলেও তারা কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এই ক্রমবর্ধমান সঙ্কট কাটাতে কোনো ধরণের আর্থিক সহযোগিতা করে না। 

গর্ভাবস্থা এবং নবজাতকের স্বাস্থ্যকে প্রায়শই অন্যান্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ের চেয়ে কম অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, এবং মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের উপর পরিবেশগত প্রভাব নীতি-নির্ধারক এবং নীতি বাস্তবায়নকারীদের খুব কমই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে  উন্নয়নশীল দেশগুলোয়।

লেখক

Leave a comment
scroll to top