Close

গ্যাবন-এ সেনা-জনতার অভ্যুত্থান হল কেন?

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গ্যাবন, গতকাল সেখানেই ৫৬ বছর পর বঙ্গো সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গ্যাবন, গতকাল সেখানেই ৫৬ বছর পর বঙ্গো সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।

গত ২৮ অগাস্ট ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রো নাইজারে বহিরাগত সামরিক হস্তক্ষেপকে সহযোগিতা করার ঘোষণার দু দিনের মাথায়, ৩০শে অগাস্ট পশ্চিমা সমর্থিত গ্যাবন সরকারকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করলো সেই দেশের সেনারা। এ যেন ফরাসি ঔদ্ধত্যের উপর এক থাপ্পড়!

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গ্যাবন, এর উত্তর-পশ্চিমে বিষুবীয় গিনি , উত্তরে ক্যামেরুন, পূর্বে ও দক্ষিণে কঙ্গোও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। গ্যাবন-এর আয়তন ২৬৭,৬৬৭ বর্গকিমি। ভারতের মাহারাষ্ট্র রাজ্য থেকে আয়তনে খানিকটা ছোটো। লিব্রভিল হল দেশের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। উপনিবেশিক আমলে দাস ব্যবসায় অন্যতম কেন্দ্র ছিলো আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী এই দেশটি।

১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করলেও, বহু আফ্রিকান দেশের মতই এই দেশটিও ফ্রান্সের নয়া উপনিবেশ বন্ধনে আবদ্ধ বলে অভিযোগ। এই দেশের সরকারি ভাষা ফরাসি। গ্যাবনবাসীদের কে সিএফএ ফ্যাঙ্ক ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়। ‘সিএফএ’-এর অর্থ ফিনান্সিয়াল কমিউনিটি অফ আফ্রিকা। ফ্রাঙ্ক ফ্রান্সের মূদ্রা। সিএফএ ফ্রাঙ্ক – মূলত ফ্রেঞ্চ আফ্রিকান উপনিবেশিক ফ্রাঙ্ক – আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ডিসেম্বর ১৯৪৫ সালে ফরাসি জেনারেল ডি গলের একটি ডিক্রি দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। এই সিএফএ ফ্রাঙ্ক ফরাসি নয়াউপনিবেশবাদের অন্যতম হাতিয়ার বলে মনে করা হয়।

২০২১ এর হিসাব অনুযায়ী গ্যাবনের জনসংখ্যা ২৩ লাখের মত। দেশের ৮৮% অঞ্চলই বনাঞ্চল। তেল, ম্যাঙ্গানিজ,কোকোয়া সমৃদ্ধ দেশ গ্যাবন-এর জনসংখ্যার এক- তৃতীয়াংশের বেশী মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২০ সালে ১৫-২৪ বছর বয়সী প্রায় ৪০% গ্যাবোনিজ লোক কর্মের বাইরে ছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি উপলব্ধি সূচকে দেশটির অবস্থান ১৩৬তম।

১৯৬৭-২০০৯ সাল পর্যন্ত ওমর বঙ্গো গ্যাবন শাসন করেন। ২০০৯ থেকে ওমর পুত্র আলি গ্যাবন শাসন করেন। অর্থাৎ, স্বাধীন গ্যাবন-এর অস্তিত্বের ৬৩ বছরের মধ্যে ৫৬ বছর, বঙ্গো পিতা-পুত্র সম্পদ সমৃদ্ধ দেশটি শাসন করেছেন। ওমর বঙ্গো ৪২ বছর গ্যাবন শাসন করেন, তার পুত্র আলি বঙ্গো শাসন করেছেন টানা ১৪ বছর। তৃতীয়বার শাসন ক্ষমতায় বসার মুখেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন।

৩০ অগাস্ট রয়টার্স একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো এই মর্মে, “বিতর্কিত/ (ডিসপুটেড)নির্বাচনের পর গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট আলি বঙ্গো তৃতীয় মেয়াদে জয়ী হয়েছেন”

এইবারের গ্যাবন নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো, বদলাতে থাকা বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিরোধীরা ব্যাপক পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন। অভিযোগ হল, বঙ্গো নির্বাচন কে কেন্দ্র করে ইন্টারনেট বন্ধ করে, সাংবাদিকদের গতিবিধি আটকে ব্যাপক নির্বাচনী কারচুপির মাধ্যমে তৃতীয়বারের জন্য ৬৪% ভোট পেয়ে নিজেকে জয়ী ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গোকে জয়ী ঘোষণার পরেই কাল বিলম্ব না করে সেনাবাহিনী তৎপর হয় এবং বঙ্গোকে গৃহবন্দী করে। এক ডজনের মত সেনা কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে বঙ্গো শাসন উচ্ছেদ এবং সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।

এর পর অভ্যুত্থানের নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠকের পর গ্যাবনের রাষ্ট্রীয় টিভিতে এক ঘোষণায় বলেছেন যে, জেনারেল ড. ব্রাইস ক্লোটায়ার ওলিগুই এনগুয়েমাকে দেশটির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি অন্তর্বর্তী কমিটির “সর্বসম্মতিক্রমে” মনোনীত সভাপতি করা হয়েছে।

গ্যাবনের হাউত ওগুইর খনিতে কর্মরত বাঙালি দ্বৈপায়ন ঘোষ ইস্ট পোস্ট বাংলাকে জানিয়েছেন, “ভোটের আগের থেকেই এখানে বোঙ্গো সরকার নানা রকমের বাঁধা দিচ্ছিল বিরোধীদের। বিরোধী প্রার্থীর প্রচার আটকানোর জন্য একের পর এক ডোমেস্টিক ফ্লাইট বাতিল করছিল গত দেড় মাস ধরে। বোঙ্গো প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল বিরোধীদের রাজধানী লিব্রেভিলে-এ সীমাবদ্ধ রাখা।এরপর ভোটের দিন বিকেল ছ’টা থেকে গোটা দেশের ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করে দেয়। সংবাদমাধ্যমেও সেন্সর করে। কোনো খবর আসছিলো না, তার মধ্যে সান্ধ্য কার্ফ্যু, রাস্তাঘাট পুলিশ, মিলিটারি দিয়ে ঘিরে ফেলে বোঙ্গো প্রশাসন। গতকাল ভোর তিনটের সময় হঠাৎ সরকারি টিভি চ্যানেল গ্যাবন২৪-এ ইলেকশন কমিশন ঘোষণা করে আলি বোঙ্গো জিতে গেছে। তার ঘন্টা খানেকের মধ্যে মিলিটারি এসে গ্যাবন২৪ আর রেডিও গ্যাবনে ঘোষণা করে তারা ক্ষমতা দখল করেছে, সরকার, সাংবিধানিক কোর্ট, সেনেট, লোকাল অ্যাডমিনিসস্ট্রেশন আর ইলেকশন কমিশনকে ভেঙে দিচ্ছে, আলি বোঙ্গোকে গৃহবন্দী করেছে। তারপর সকাল সাড়ে সাতটার সময় ইন্টারনেট পরিসেবা চালু করে। গতকাল সন্ধ্যা ছ’টায় মিলিটারি কাউন্সিল জেনারেল ব্রিস ওলিগুই গুইয়েমাকে অন্তর্বর্তী নেতা ঘোষণা করে ও সন্ধ্যা ছ’টা থেকে সকাল ছ’টা পর্যন্ত কার্ফ্যু জারি রেখেছে।সমস্ত আন্তর্জাতিক সীমান্ত এখনও বন্ধ”।

আলি ৬৪% ভোট পেলেও তার সপক্ষে কোনো গণবিক্ষোভ কিন্তু এখনো সংবাদ মাধ্যমের নজরে আসেনি। যেমনটা মায়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের পর আন সাং সুকির সমর্থনে হয়েছিলো। বরং অভ্যুত্থানের সমর্থনে সেনাদের স্বাগত জানানোর জন্য রাস্তায় মানুষের ঢল দেখা যায়।

আলি বঙ্গো গৃহবন্দী হওয়ার পর এক ভিডিওবার্তার মাধ্যমে তিনি গৃহবন্দী হওয়ার পর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেন এবং তার সমর্থকদের হইচই করার আবেদন জানান।

গ্যাবন প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ হলেও, এবং সরকারি ভাষা ফরাসি হলেও, বঙ্গো ইংরেজি ভাষায় তার ভিডিও বার্তায় বলেন, আমি আমাদের সারা বিশ্বে যে সমস্ত বন্ধুরা আছে, তাদের কাছে একটি বার্তা পাঠাচ্ছি যে তারা শোরগোল করুন…”।

“আমি বাড়িতে আছি এবং কিছুই ঘটছে না, আমি জানি না কি ঘটছে! আমি শোরগোল করার জন্য আপনাদের আহবান করছি।”

কেউ কেউ বিদ্রুপের সুরে বলেছে যে, নির্বাচনের সময় আলি বঙ্গো ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, এখন তিনি ইন্টারনেট ব্যবহার করে সাহায্য চাইছেন।

বর্তমানে গ্যাবন মিলিয়ে মোট সাতটি দেশ সেনা শাসনে এলো। বাকি ছয়টি দেশ হল গিনি, বুরকিনা ফাসো, মালি, নাইজার, চাদ এবং সুদান। মাত্র একমাস আগেই নাইজারে ফ্রান্স পন্থী শাসক মহোমেস বাজউমকে উৎখাত করে উপনিবেশিকতা বিরোধী সেন-জনতা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২০২১ সালে গিনিতে, ২০২২ সালে বুর্কিনা ফাসো এবং মালিতে। এর মধ্যে সুদান বাদ দিয়ে বাকি ছয়টি দেশের সেনা শাসনকে জনতা বড় সংখ্যায় রাস্তায় নেমে স্বাগত জানিয়েছে। এর মধ্যে গ্যাবনের জনতা ফরাসি নয়া উপনিবেশবাদ বিরোধী অবস্থান নেয়। গ্যাবনের সেনা এখনো সেরকম কিছু ঘোষণা করেছে বলে জানা যায়নি। অন্যদিকে গিনি,বুর্কিনা ফাসো, মালি, চাদ এবং নাইজার স্পষ্ট ভাবে নয়া উপনিবেশবাদ বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ফ্রান্সকে ইউরেনিয়াম, সোনা ইত্যাদি সরবরাহ করতে অস্বীকার করে, সরকারি ভাষা হিসেবে ফরাসিকে ত্যাগ করে। চাদ এই বছরই মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা এক্সনমোবিলের জাতীয়করণ করে।



দ্বৈপায়ন ঘোষ ইস্ট পোস্ট বাংলাকে আরও বলেছেন, “আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হচ্ছে, ভারতীয় কম্পানি গুলো অপারেশন চালু করেছে। ফরাসি কম্পানিগুলো এখনো কাজ বন্ধ রেখেছে। মানুষের মধ্যে এখনো একটা দোটানা আছে,তবে বোঙ্গো সরকারের পতনে মানুষ খুব কষ্ট পায়নি।”

“ফ্রান্স গ্যাবোনে চলমান সামরিক অভ্যুত্থানকে নিন্দা জানায় এবং দেশটিতে যে বিকাশ ঘটছে তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, এবং ফ্রান্স তার ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করে যে নির্বাচনের ফলাফল একবার জানা গেলে তা সম্মান করা হবে,” ফরাসি সরকারের মুখপাত্র অলিভিয়ার ভেরান বলেছেন।

“মস্কো বন্ধুত্বপূর্ণ আফ্রিকান দেশে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির তীব্র অবনতির খবর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমরা পরিস্থিতির বিকাশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছি এবং এর দ্রুত স্থিতিশীলতার আশা করি,” বলেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা।

“চীন গ্যাবনে পরিস্থিতির বিকাশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং গ্যাবনের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলিকে … যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাভাবিক ক্রম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বঙ্গর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, জাতীয় শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সামগ্রিক উন্নয়ন বজায় রাখুন,” বলেছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন।

“এটা উদ্বেগ উদ্দীপক এটিকে ঘনিষ্ঠভাবে গণনা করবে আমরা এবং আফ্রিকান জনগণের দ্বারা প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক আদর্শকে সমর্থন করার জন্য আমরা কিছু করতে পারি তা রক্ষা করার জন্য,” হোয়াইট করতে হাউস জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কির্বি বলেছেন।

আলি বঙ্গো সেই সমস্ত ফ্রান্স এবং পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্র নায়কদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গত দুই বছরে আফ্রিকায় জনতার সমর্থনে ক্ষমতায় আসা সেনারা ফরাসি নয়া-উপনিবেশ গুলোর মধ্যে স্পষ্ট ভাঙন ধরিয়েছে। স্পষ্টতেই গ্যাবন আফ্রিকার ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিদের আধিপত্যের উপর একটা বড় ধাক্কা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনও।

সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

Leave a comment
scroll to top