মার্কিন সাংবাদিক এডগার স্নো “চীনের আকাশে লাল তারা” নামে একটা বই লিখেছিলেন। “লাল তারা” শব্দটা তিনি রূপক হিসেবে উদীয়মান কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু আমেরিকার আকাশে লালা তারার কোনো সম্ভাবনা দেখা না গেলেও এবার আক্ষরিক অর্থেই আমেরিকার আকাশে সাদা বেলুন দেখা গেল। এই বেলুন মার্কিন বা পশ্চিমা মিডিয়ায় এমন তোলপাড় ফেলে দিয়েছে যে হয়তো আগামি দিনে কোনো সাংবাদিক “আমেরিকার আকাশে সাদা বেলুন” নামে কোনো বই লিখে ফেলবেন।
সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের কর্মকর্তা জানিয়েছেন,রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এই নিয়ে সামরিক বাহিনীকে পদক্ষেপ নেওয়ার হুকুম দেন। সাদা বেলুনটিকে ভূপতিত করার ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল। কিন্তু এটা করলে নীচে থাকা লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারতো বলে কর্মকর্তারা মনে করেন। তাছাড়া এই বেলুনটি নিয়ে অসামরিক বিমান পরিবহণের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয় বলে দাবি করে পেন্টাগন। সেকারণেই ২দিন ধরে কোনো বড় পদক্ষেপ নেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এক আধিকারিক জানিয়েছেন পুরো বোঝা যাচ্ছে গোপনে নজরদারির জন্য বেলুনটি পাঠানো হয়েছিল। বেলুনটি উত্তর পশ্চিম আমেরিকার উপর দিয়ে উড়ছিল। তার নীচে এয়ারবেস রয়েছে। পারমাণবিক মিসাইলের ভাণ্ডার রয়েছে। তবে পেন্টাগনের তরফে জানানো হয়েছে এটা আমেরিকার পক্ষে বড় কোনও হুমকি নয়। তবে বেলুনের গতিবিধির উপর নজর রাখা হচ্ছে। অবশেষে ২ দিন পর শনিবার মিসাইল মেরে বেলুনটি ধ্বংস করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সত্যি যদি পারমানবিক মিসাইলের ভান্ডার এবং বিমান ঘাটির মত সংবেদনশীল ক্ষেত্রের উপর গোয়েন্দা নজর চালাতে চীন সরকার ঐ বেলুন পাঠিয়ে থাকে তবে তা কেন মার্কিন সরকারের কাছে হুমকি নয় বা কেন মাটিতে আতঙ্ক ছড়াতে দিয়ে আকাশে বেলুনটিকে রেখে দেওয়া হয়েছিলো দু-দিনের বেশী সেটা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তৈরি করে। তা ছাড়া সুক্ষ প্রযুক্তি বা উপগ্রহের যুগে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তিতে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়া চীন কেন নজরদারি চালাতে ঢাউস বেলুন পাঠাবে, সেটাও একটা প্রশ্ন।
চীন দাবি করেছে এটা নিতান্তই অসামরিক বেলুন, যা আবহাওয়া গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়। দুর্ঘটনাবসত, অনিচ্ছাকৃত ভাবে বেলুনটি আমেরিকার আকাশ সীমায় প্রবেশ করেছে। কিছু মার্কিন রাজনীতিবিদ এবং সংবাদমাধ্যম চীনকে আক্রমণ করার জন্য এই ঘটনাকে ব্যবহার করছে বলে দাবি চীনের। রবিবার বিবৃতি দিয়ে চীনের বিদেশ মন্ত্রক মিসাইল মেরে বেলুন ধ্বংস করাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “বাড়াবাড়ি” বলে তিরস্কার করেছে। চীনের দাবি বেলুন নিয়ে বার বার সরকারি ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করা হলেও একটা নিরীহ বেলুনকে তারা ধ্বংস করেছে। বলা বাহুল্য মশা মারতে কামান দাগার মত মিসাইল ছুড়ে বেলুন ফাটানোর ঘটনা ক্রমশ উত্তেজনাপূর্ন হতে থাকা চীন-মার্কিন বৈদেশিক সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটাবে।
অন্যদিকে দ্বিতীয় একটি চীনা বেলুনের আতঙ্ক ছড়ায়। ফ্লাইটর্যাডার২৪ জানায় এই বেলুনটি চীনা বেলুন নয়। যদিও এই বেলুনটাকেও চীনে বেলুন ভেবে বহু মানুষ এটির গতিবিধির উপর নজর রাখতে শুরু করে।রয়টার্স জানিয়েছে যে HBAL617 নামের বেলুনটি N257TH রেজিস্ট্রেশন নম্বর সহ দক্ষিণ ডাকোটা ভিত্তিক একটি মহাকাশ সংস্থা অ্যারোস্টারের।
শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সাথে ফোনালাপে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিশনের অফিসের পরিচালক ওয়াং ই বলেছেন, “চীন একটি দায়িত্বশীল দেশ এবং সবসময় আন্তর্জাতিক আইন কঠোরভাবে মেনে চলে। আমরা কোনো ভিত্তিহীন জল্পনা-কল্পনা এবং প্রচার বরদাস্ত করবো না।”
এর মধ্যে জানা গেল আগামী ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারি চীন সফরে যাচ্ছেন না সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন যে বেলুনে কান্ডের কারণে ব্লিঙ্কেন তার চীন সফর অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছেন। মার্কিন সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন জানাচ্ছে ব্লিঙ্কেন বলেছেন “মার্কিন আকাশসীমায় এই নজরদারি বেলুনের উপস্থিতি, মার্কিন সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন… মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নজরদারি বেলুন উড়ানোর চীনের সিদ্ধান্ত একই সাথে অগ্রহণযোগ্য এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন…এটি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যা সফরের উদ্দেশ্যকে ক্ষুন্ন করেছে।”
ব্লিঙ্কেন যে সফর বাতিল করলেন, সেই সফর আদৌ কখনো নির্ধারিত হয়েছিলো কী না সেই নিয়ে সন্দেহ জাগায় চীনের তরফের বিবৃতি। এর আগে ব্লিঙ্কেনের নির্ধারিত চীন সফরের কথা মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে বলা হলেও, চীন কখনোই এই সফরের কথা সরকারি ভাবে জানায়নি। এমনকি মার্কিনিরাও সরকারি ভাবে এই সফরের কথা কখনো ঘোষণা করেনি। ১৭ জানুয়ারি মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএন বেনামি এক মার্কিন কূটনীতিকের বরাত দিয়ে দাবি করে যে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি ব্লিঙ্কেন চীন সফরে যাচ্ছেন। ব্লিঙ্কেনের এই সফর হল বালিতে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের বৈঠকের ধারাবাহিকতা বলে দাবি করে সংবাদমাধ্যমটি। ২০২২ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি টুয়েন্টি সম্মেলনের মাঝে বৈঠক করেন শি-বাইডেন।
চীনের সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস থেকে জানা যাচ্ছে ব্লিঙ্কনের সফর বাতিল প্রসঙ্গে যে চীনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেছে “আসলে, কোনো পক্ষই কখনো ঘোষণা করেনি যে কোনো সফর হবে, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ঘোষণা থেকে জানা গেল, আমরা এটাকে সম্মান জানাই”। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের কাদম্বরী মরিয়া প্রমান করিল, সে মরে নাই” এর মতনই ব্লিঙ্কেন চীন সফর বাতিল ঘোষণা করার পরেই চীন জানতে পারলো যে ব্লিঙ্কেনের চীন সফরের কোনো পরিকল্পনা ছিলো।
এর আগে ২৭শে জানুয়ারি ২০২৫ সালে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এমন আশঙ্কা করে বিমান বাহিনীর কমান্ডারদেরকে নিজ নিজ ইউনিট সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন বিমান বাহিনীর মোবিলিটি কমান্ডের চিফ জেনারেল মাইক মিনিহান। সুতরাং শীতল যুদ্ধের বাতাবরণ আবার তৈরি হচ্ছে এমন বলাটা অত্যুক্তি হবে না। বিশেষত এতদিন বিভিন্ন দেশে মার্কিনিরা ব্যাপকভাবে আকাশপথে নজরদারি এবং হামলা চালাবার ফলে তাদের বেলুনে সিঁদুরে মেঘ দেখাটা অস্বাভাবিক নয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে ৪ অক্টোবর ১৯৫৭ সালে মহাকাশে প্রথম স্পুৎনিক নামে উপগ্রহ পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই সময় মার্কিনিদের কৃত্রিম উপগ্রহ সম্বন্ধে তেমন ধারণা না থাকায় মাথার উপর সোভিয়েত উপগ্রহ নিয়ে মার্কিনীরা আতঙ্কিত হতেন। বিশেষত শীতল যুদ্ধের পরিবেশে এক শ্রেনীর রাজনীতিবিদ এবং সংবাদমাধ্যম আতঙ্কের পরিবেশ গড়ে তোলে। পরবর্তীতে মার্কিনিরা উপগ্রহ প্রযুক্তি এবং আকাশ প্রতিরক্ষায় বড় সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু এর পরে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বেলুন নিয়ে এই আতঙ্ক সত্যি অবাক না করে পারেনা।