রবিবার রাতে আজারবাইজানের সীমান্তের মধ্যেই হঠাৎ দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয় ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসির চপার। দুর্ঘটনায় মারা যান রাইসি সহ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান। কিন্তু নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত হত্যা? উঠে আসছে ‘মোসাদ’-এর নাম। ঘটনার দিনই স্থানীয় সময় দুপুর ১টা নাগাদ ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলির তরফ থেকে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে রাইসির চপারটি ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করার আগে রাডারের বাইরে চলে গিয়েছিল। এরপর কিছু পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার অনেকগুলো মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। প্রথমদিকে, এমন খবর বাইরে এসেছিল যে রাষ্ট্রপতি রাইসি এবং বোর্ডে থাকা অন্যান্যরা বেঁচে গিয়েছেন এবং একটি মোটরগাড়িতে তাব্রিজের পথে যাচ্ছিলেন। পরে এটিকে মিথ্যা বলে দাবি করা হয়।
উদ্ধারকারী দলগুলি মারফৎ জানা গিয়েছে প্রতিকূল আবহাওয়া এবং ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের কঠিন ভূখণ্ডের কারণে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর জন্য অভিযান পরিচালনা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ছিল। রাষ্ট্রপতির কাফেলায় তিনটি হেলিকপ্টার ছিল বলে জানা গেছে; বাকি দুটি মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের নিয়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছেছে বলে খবর। বিভিন্ন সূত্র থেকে এভাবে দুর্ঘটনার নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেও এখনও এই মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে। করাটাও আশ্চর্যের নয় কারণ দেশটা ইরান এবং এর শত্রু ইসরায়েল।
ইসরায়েলের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর কর্মকাণ্ডের ইতিহাস দেখে তাঁদের কথাও উড়িয়ে দিতে পারছেন না অনেকে। বিশেষত যখন গত মাসেই ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তখন এমন ভাবনা অমূলক নয়। যদিও বরাবর ইসরায়েলের সাথে তিক্ত সম্পর্ক ছিল না ইরানের। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজতন্ত্রের সময় শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সাথে ভালোই সম্পর্ক ছিল ইহুদী রাষ্ট্রের। পরিস্থিতি বদলে যায় ইসলামিক বিপ্লবের পর মার্কিন মদতপুষ্ট শাসক সরে যাওয়ায়। তিক্ত হতে থাকে উভয়ের সম্পর্ক।
সাম্প্রতিক অতীতে ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে লাগাতার হামাসের পক্ষে থেকেছেন রাইসি। যুদ্ধ চলাকালীন হামাসকে সাহায্য করার জন্য তেহেরানকে অভিযুক্তও করা হয় ইসরায়েল ও তার বন্ধু রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে। এছাড়াও ইসরায়েলে আক্রমণ করার জন্য সিরিয়া, ইয়েমেনের মতো দেশগুলিকে উস্কানি দেওয়ারও অভিযোগ ছিল ইরানের বিরুদ্ধে। যদিও সরাসরি হামাসকে বা অন্য কোনও শক্তিকে সাহায্য করার অভিযোগ উড়িয়ে দেন রাইসি। তবুও এই ঠান্ডা সম্পর্কের জেরেই গত ১লা এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে আক্রমণ চালায় ইসরায়েল। তাতে নিহত হন ইরানের দুই সেনা কর্মকর্তা। পাল্টা হামলা করে ইরান। যুদ্ধ শুরু হয়। এক্ষেত্রে ইরান যুদ্ধের রাশ টেনে ধরলেও হিংসার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল।
অন্যদিকে, রবিবার আজারবাইজানে একটি কর্মসূচি সেরে ইরানের মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়ে দেশে ফিরছিলেন রাইসি। দেশের পূর্বের এই পড়শির সাথেও খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না ইরানের। তারও অন্যতম কারণ ইসরায়েলের সাথে আজারবাইজানের বন্ধুত্ব। আজারবাইজানের বিরুদ্ধেও নানাভাবে মোসাদ-কে সাহায্য করার অভিযোগ আছে। তাই রবিবার আজারবাইজানের সীমান্তের মধ্যেই এই দুর্ঘটনা এবং তার জেরে রাইসির মৃত্যুকে আচমকা দুর্ঘটনা বলে মনে করতে পারছেন না অনেকে।
যদিও এই তত্ত্বকে ‘কন্সপিরেসি থিওরি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই। তাঁদের যুক্তি, ইসরায়েল বা মোসাদ অতীতে কখনও কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের উপর সরাসরি হামলা চালায়নি। তাঁরা মূলত চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে পরিকাঠামো ধ্বংস করে অথবা অর্থনৈতিক স্বার্থ নষ্ট করে। তাই রাইসির মৃত্যুতে মোসাদ-এর হাত নেই বলে মনে করছে আর এক দল। এছাড়াও সাধারণ দুর্ঘটনা না হয়ে এটা যদি ষড়যন্ত্র হয়েই থাকে তবে বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি অনুযায়ী এর অভিযোগের তীর স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েলের বা মোসাদের দিকেই থাকার কথা। তা যদি হয় তবে নিশ্চিত অভিযোগের সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে তারা এটা করবে কেন? আর তারা যদি না করে থাকে তবে করল কে? লক্ষ টাকার প্রশ্ন! কাদের এতে কী স্বার্থ সিদ্ধি হতে পারে তা নিয়ে আপাতত বিশ্ব রাজনীতি চমৎকার জায়গায় দাঁড়িয়ে।
৬৩ বছরের রাইসি ইরানের অন্যতম বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি। চরম রক্ষণশীল এই ব্যক্তি খলিফা আয়াতোল্লা খোমেইনীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এতটাই যে একসময় খোমেইনীর উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর নাম উঠে এসেছিল। ২০২১ সালে ইরানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর আইন করে ইরানী নারীদের চালচলনে চরম রক্ষণশীলতা আরোপ করেন রাইসি। ফলে হিজাব ঠিক মতো না পরায় নিহত হন মাশা আমিনী নামের এক কুর্দি নারী। সাথে সাথেই দেশ জুড়ে মাশার সমর্থনে ইরানের রাজপথ দখল করে নারীরা। কোথাও তারা নিজের চুল কেটে ফেলে আবার কোথাও হিজাব/ বোরখা পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। বিরোধীদের মতো এই বিক্ষোভের সময় ইরানের প্রশাসনের হাতে শতশত বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়। যদিও এই আন্দোলনের পেছনেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া দেখেছিলেন ইরানের সরকারপন্থীরা।