Close

সৌদির চিঠি: নবী দিবসে নেই কোনও চিকনাই (পর্ব ২১)

নবী দিবসে জাঁকজমকপূর্ণ বাংলা তথা ভারতের মুসলমান সমাজ। কিন্তু আলোর রোশনাই নেই সৌদির অলি-গলিতে। কেন? লিখছেন পথিকৃৎ।

নবী দিবসে জাঁকজমকপূর্ণ বাংলা তথা ভারতের মুসলমান সমাজ। কিন্তু আলোর রোশনাই নেই সৌদির অলি-গলিতে। কেন? লিখছেন পথিকৃৎ।

সৌদির চিঠি পর্ব ২০

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে এই সপ্তাহে বেশ জাঁকজমকের সাথে নবী দিবস পালন হচ্ছে দেখলাম। সৌদি থেকে পশ্চিম বাংলায় আমার পরিবারকে ফোন করতে শুনলাম পাশের মসজিদ থেকে বেশ জোরে মাইকের আওয়াজ আসছে নবী দিবস উদযাপনের জন্য। কিন্তু এখানে যেন কিছুই নেই, ভারতীয় বন্ধুরা না জানালে জানতেই পারতাম না যে নবী দিবস পালন হচ্ছে! এত চুপচাপ কেন জানার জন্য যখন দীর্ঘদিন ধরে এখানে থাকা একজন ভারতীয় মুসলমান বন্ধু কে জিগ্যেস করলাম, সে জানআলো যে সৌদি আরবে ওরকম কোনো উল্লাস হয়না এইসব নিয়ে, এক পবিত্র উৎসবের ক্ষেত্রে কোনোরকম হই হট্টোগোলের প্রয়োজন হয়নি নাকি। এক সপ্তাহ আগেই ন্যাশনাল ডে অথবা সৌদি জাতীয় দিবসে এদের চেহারা দেখে এই ব্যাপারটাই একটু মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম আর কি!

জাতীয় দিবসের রাতে সমস্ত রিয়াধ শহর যেন রাস্তায় নেমে এসেছিল। সকলে নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু কেউ কোথাও যাচ্ছে না, সবাই শুধু রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে উল্লাস। সেই কারনে শহর বন্ধ করে দেওয়ার মতো যানজট। আর সেটার জন্য যে যেখানে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই নেমে নাচানাচি, পিচকারি দিয়ে জল খেলা, বাচ্চাদের ললিপপ দেওয়া ইত্যাদি! কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই যেন এত আনন্দের পেছনে থাকা লক্ষ লক্ষ পরিশ্রান্ত চেহারা গুলো নজরে পড়বে। এতদিন আমরা নিজেরা ঈদ, দুর্গা পুজোর মতো আনন্দোৎসব গুলো উপভোগ করতে এতই ব্যস্ত থাকি যে সেই উপলক্ষ গুলোকে উৎসব হিসেবে বৃদ্ধি পাওয়ানোর নিরন্তর প্রচেষ্টা গুলো খেয়াল করে দেখিনি। আজকাল অবশ্য এইসব নিয়ে অনেক লেখালেখি, ফিচার ফিল্ম, এইসব হচ্ছে, কিন্তু তা শুধু মাত্র আমাদের আড্ডার খোরাক হিসেবেই থেকে যায়, সেইসব নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ এবং সমাধানের চিন্তাভাবনা কিছুই হয়না।

সেদিন রাতে এক বাংলাদেশি ডেলিভারি রাইডার আমাদের দোকান থেকে এক সৌদি পরিবারের হাতে খাবার পৌঁছে দিতে গিয়ে তাদের কাছে বেশি দাম দাবি করে বসেছিলেন। সেই খাবার যিনি অর্ডার করেছিলেন, তিনি ভয় পেয়ে রাত দেড়টায় আমায় ফোন করে জানালেন যে রাইডার নাকি পুলিশ ডাকার হুমকি দিচ্ছে, যদি তাকে খাবারের দামের চেয়ে বেশি আরো দাম না দেওয়া হয়। আমি তখন রাস্তা হারিয়ে ট্রাফিক জ্যামে ফেঁসে বাড়ি ফেরার রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করছি। এই কথা শুনে আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হতো। আমার খদ্দের কে সহযোগিতা করে ওই রাইডারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর কথা বলা, নাকি আমার মতোই এক কর্মরত বাঙালির পাশে দাঁড়িয়ে তার হয়ে যুক্তি দেওয়া। আমি উপায় হারিয়ে প্রথম পথটাই বেছে নিলাম, জানি যেকোনো শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সেটাই করবে। কিন্তু বাকি বাঙালি শ্রমিকরা এই ব্যাপারটা শুনে কিছু না ভেবেই বলে উঠলো, যে সেই ব্যাক্তিটির সমপূর্ণ অধিকার আছে এমন দাবি করার!

সারা সন্ধ্যা ধরে সে শুধু ওই একটা অর্ডারের জন্য রাস্তায় পড়ে থেকেছে, এখন অবশ্যই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া উচিত, সে যেভাবেই হোক। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তারা আসল বিষয় গুলো খতিয়ে দেখার ধৈর্য রাখেন না। তআরআ মনে করেন সৌদিরা বাঙালিদের চাকর হিসেবে দেখে তাই যখন যেভাবেই হোক, এদের থেকে টাকা উসুল করে নেওয়া উচিত। কিন্তু তাতে শুধু্ নিজেদের একরকমের দস্যু প্রবণতাই সামনে আসে, আসল কাজের কাজ অথবা কোনোরকম কার্যকরী স্টেটমেন্ট তৈরি হয়না। এই ক্ষেত্রে আরো শয়ে শয়ে খেটে খাওয়া ডেলিভারি কর্মীদের মতো সেই বাঙালি রাইডারের সারারাতের ভোগান্তির দায় কাকে নিতে হবে? যেই সৌদি পরিবার বছরের ব্যস্ততম রাতে ওনার মতো হাজার হাজার অসহায় কর্মীদের কাজে থাকার ফায়দা ওঠালেন, নাকি সেই কোম্পানি গুলো যারা এমন চূড়ান্ত পরিস্থিতিতেও রাইডারদের কোনো ছাড় অথবা বোনাস না দিয়ে মুনাফার লোভে এই অসম্ভব টার্গেট পূরনের কাজে ঠেলে দিয়েছে? যদি ঝামেলা করে টাকা উসুল করতেই হয়, নিজের এত খাটুনির উপযুক্ত পারিশ্রমিকের হক দাবি জানানোর সময় আসে, তখন কাছ প্রশ্ন করা উচিত, পণ্য ভোগ করা ক্রেতা নাকি মুনাফা লুট করা মালিকপক্ষ?

Leave a comment
scroll to top