অবশেষে প্রায় পাঁচ মাস পর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে ইন্টারনেট পরিষেবা পুনরুদ্ধার করা হবে। মণিপুরের ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞা আংশিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছিল, তবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং শনিবার ঘোষণা করেছেন যে অবশিষ্ট পরিষেবাগুলি এখন অবিলম্বে কার্যকর হবে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে “ভুঁয়ো খবর, প্রচার এবং ঘৃণাত্মক বক্তব্যের বিস্তার রোধ করতেই রাজ্যে ইন্টারনেট স্থগিত করা হয়েছিল।” এর সাথে তিনি সংযোজন করেছেন,”তবে পরিস্থিতির উন্নতির সাথে সাথে, আজ থেকে রাজ্য জুড়ে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা পুনরুদ্ধার করা হবে।”
বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্রে খবর, মণিপুর রাজ্য সরকার জনগণকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পুলিশ স্টেশনগুলি থেকে লুঠ করা অস্ত্র সমর্পণ করার আহ্বান জানানোর ঠিক এক দিন পর এই ঘোষণা এসেছে। সেই সময়ের পরে, রাজ্যে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনী “এই ধরনের অস্ত্র উদ্ধারের জন্য একটি ব্যাপক শক্তিশালী অনুসন্ধান অভিযান চালাবে,” মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, যার কাছে অবৈধ অস্ত্রের হদিস পাওয়া যাবে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। গত ৩রা মে মণিপুরে জাতিগত সহিংসতা বৃদ্ধি পায় যা দুটি বৃহত্তম সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করে। মেইতেই জনগণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা ইম্ফল উপত্যকায় বাস করে এবং পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের কুকি উপজাতি সম্প্রদায়, এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই কার্যত লাগাতার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এখনও পর্যন্ত প্রায় ২০০ জন মানুষ এই সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ এখনও ত্রাণ শিবিরে রয়েছে। মেইতেই জাতির অধীন নাগরিকেরা ভারতের সংবিধান অনুযায়ী শিডিউল্ড ট্রাইব তকমা পাওয়ার একটি সরকারি ঘোষণার প্রতিবাদে কুকি জনজাতির মানুষের নেতৃত্বে ‘উপজাতি সংহতি মিছিল’ সংগঠিত হওয়ার পর প্রথম সহিংসতা শুরু হয়।
গত আগস্ট মাসে রুশ সংবাদমাধ্যম আর.টি নিউজের সাথে কথা বলার সময় মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং মণিপুর-এ শান্তির জন্য আবেদন করেছিলেন। এই বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে যদি চলমান সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়গুলি “ক্ষমা এবং ভুলে যাওয়ার” পথ অবলম্বন করলে তবেই তা অর্জন করা যেতে পারে। চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে রাজ্য সরকার রাজধানী ইম্ফলে সম্পূর্ণ কারফিউ পুনরায় জারি করেছিল। এই পদক্ষেপটি পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষের পরে নেওয়া হয়, যখন “পুলিশের ছদ্মবেশে” এবং “পুলিশ অস্ত্রাগার থেকে লুঠ করা” অত্যাধুনিক অস্ত্র বহন করার অভিযোগে গত সপ্তাহে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করার পরে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমেছিল।
মণিপুর পুলিশ তাদের সকলের বিরুদ্ধে “কঠোর পদক্ষেপের” হুঁশিয়ারি দিয়েছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে আনলফুল অ্যাক্টিভিটি প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ইউএপিএ) আইনের আওতায় মামলা করেছিল, যা একটি বিতর্কিত আইন। পুলিশের বক্তব্য ছিল যে অভিযুক্তরা “উত্তেজক উদ্দেশ্য” সাধনের জন্য ইউনিফর্মের অপব্যবহার করেছে এবং বলেছে যে “চাঁদাবাজির হুমকি, পুলিশের ইউনিফর্মের অপব্যবহার এবং সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের ছদ্মবেশী হওয়ার রিপোর্টের ভিত্তিতেই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।” হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দুজন এই অঞ্চলের নিষিদ্ধ গোষ্ঠী পিএলএ এবং কাংলেইপাক কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। যদিও স্থানীয়দের মতে, হেফাজতে থাকা ব্যক্তিরা “গ্রাম প্রতিরক্ষা স্বেচ্ছাসেবক” বা সতর্ককারী যারা মণিপুরে জাতিগত সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরে তাদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র তুলেছিল। স্থানীয় জনসাধারণের মতে প্রশাসন তাদের মিথ্যা মামলার গ্রেফতার করেছে। এই মর্মে ইউএপিএ-র আওতায় মামলা তুলে নেওয়ার দাবিতে সাধারণ মানুষ গত বুধবার থেকে ৪৮ ঘন্টা বন্ধ ঘোষণা করে। সেখানে দফায় দফায় তারা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়েছে বলে সূত্রের খবর।
এই সপ্তাহে মণিপুরের ছয়টি উপত্যকা জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ, বেসামরিক জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ এবং পাথর নিক্ষেপের খবর পাওয়া গেছে, যে অঞ্চলগুলি প্রধানত মেইতেই সম্প্রদায়ের দ্বারা অধ্যুষিত। গ্রেফতারকৃত অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে ইম্ফল পূর্ব, ইম্ফল পশ্চিম, বিষ্ণুপুর এবং অন্যান্য স্থানীয় জেলাগুলিতে একটি বিশাল সংখ্যক বিক্ষোভকারী, যাদের বেশিরভাগই মহিলা, বেশ কয়েকটি থানা ঘেরাও করার চেষ্টা করেছিল। পুলিশ বিক্ষোভ দমন করতে স্মোক বোমা ও কাঁদানে গ্যাস মোতায়েন করায় সংঘর্ষে একজন মহিলা সাংবাদিক সহ মোট ৩০ জন আহত হয়েছেন।
এই ঘটনার পর, রাজ্য সরকার “যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এবং জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে” কারফিউ জারি করেছে। যদিও স্বাস্থ্যসেবা, ইউটিলিটি এবং মিডিয়ার মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলিতে যারা কাজ করছেন তাদের জন্য ছাড় ছিল। স্থানীয়দের ব্যাপক চাপের পর শুক্রবার সন্ধ্যায় স্থানীয় আদালত থেকে গ্রেফতারকৃতদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। যাইহোক, শুক্রবার বিকেলের মধ্যে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) দ্বারা একজনকে পুনরায় গ্রেপ্তার করার পরে ইম্ফলে নতুন সংঘর্ষ শুরু হয়। তবে, ইম্ফলের পরিস্থিতি “স্বাভাবিক” এ ফিরে এসেছে বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। এই শনিবার, অনেক স্কুল, দোকান এবং অফিসও আবার খুলেছে বলে জানা গিয়েছে।