হন্ডুরাসে আবার সেনা অভ্যুত্থান-এর আশঙ্কা করছেন রাষ্ট্রপতি শিওমারা কাস্ত্রো। গত মঙ্গলবার বিকেলে হন্ডুরাসের রাজধানী তেগুসিগালপায় জমায়েত জনতার লাল সাগরে পরিনত হয়। ভাষণ দেওয়ার সময়, শিওমারা ঘোষণা করেন “আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত এবং প্রতিরোধে সংঘবদ্ধ থাকতে হবে যাতে হন্ডুরাসে আর কোনো অভ্যুত্থান, মাদক-স্বৈরশাসক বা লুণ্ঠন না হয়।”
হান্ডুরাসে এবারে সঙ্ঘাত নতুন অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। দেশের বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল অস্কার চিনচিলার মেয়াদ ৩১শে অগাস্ট শেষ হওয়া এবং নতুন একজনকে নির্বাচন করার সরকারি সিদ্ধান্তে, নতুন করে উত্তেজনার ছড়িয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলকে ১২৮ জন বিধায়কের মধ্যে কমপক্ষে ৮৬ জনের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে যাতে তারা ১লা সেপ্টেম্বর থেকে তাদের পাঁচ বছরের মেয়াদ গ্রহণ করতে পারে। এই নির্বাচন বয়কট করেছে রক্ষনশীল বিরোধীরা। ফলত ভেস্তে গেছে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল এর দায়িত্ব গ্রহণ করার প্রক্রিয়া।
হান্ডুরাসের শাসক লিবার্টি এন্ড রিফাউন্ডেশন পার্টির অভিযোগ ন্যাশনাল পার্টি এবং দেশপ্রেমিক জোট এবং সালভাদর হন্ডুরাস দলগুলি সরকারের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান চালানোর লক্ষ্যে অস্থিতিশীলতার প্রচারণার অংশ হিসেবে এই অসহযোগিতা শুরু করেছে। নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য ডানপন্থী বিরোধী ডেপুটিদের প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপ্রধান, মঙ্গলবার সমাবেশের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
অন্যদিকে দক্ষিণপন্থীদের অভিযোগ শাসক দল হন্ডুরাসে সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। প্রসঙ্গত অ্যাটর্নি জেনারেল চিনচিলার ন্যাশেনাল পার্টির ঘনিষ্ঠ, তিনি ২০১৩ সাল থেকে পদে আছেন।
ন্যাশেনাল পার্টির নেতা এবং ক্ষমতায় থাকা রাষ্ট্রপতি জুয়ান অরল্যান্ডো হার্নান্দেজ আলভারাডোকে হারিয়ে শিওমারা কাস্ত্র(৬৫), ২০২২ সালের নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রপতি হন, তিনি হন্ডুরাসের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি। ১৭ লাখ ভোট পান, যা হন্ডুরাসের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোট।
শিওমারার স্বামী ম্যানুয়েল জেলায়া ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, ২০০৯ সালে অভ্যত্থানের মাধ্যমে উচ্ছেদ হন। প্রসঙ্গত, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জুয়ান অরল্যান্ডো হার্নান্দেজ আলভারাডো দণ্ডিত মাদক পাচারকারী টনি হার্নান্দেজের ভাই।অরল্যান্ডো নিজেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, যদিও পরবর্তীতে মামলা থেকে তিনি মুক্তি পান।
শিওমারার স্বামী জেলায়া নতুন করে সংবিধান লেখার জন্য গণপরিষদ আহ্বান করতে গণভোটের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। ২৮শে জুন ২০০৯ সালে সুপ্রিমকোর্টের আদেশে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতি জেলায়াকে উচ্ছেদ করে। এরপর টানা ১২ বছর রক্ষণশীল ন্যাশেনাল পার্টি ক্ষমতায় ছিলো।
এর আগে ১৯৫৯ সালে হান্ডুরাসে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা হয়। যদিও বিরাট সংখ্যায় ছাত্র এবং ইউনিয়নিস্টরা রাস্তায় নেমে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়। এর পর ১৯৬৩ সালে হন্ডুরাসে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। রাষ্ট্রপতি ভিলেদা মোরালেস প্রগতিশীল শ্রম আইন এবং একটি কৃষি সংস্কার নীতি প্রবর্তন করেছিলেন, রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে হন্ডুরাসের ডানপন্থী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্ট সহানুভূতির অভিযোগ তুলেছিল। কুখ্যাত মার্কিন সংস্থা ইউনাইটেড ফ্রুট কম্পানির জমি অধিগ্রহণের সরকারি পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে এই সঙ্ঘাতের সূত্রপাত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হন্ডুরাসের সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বহু হন্ডুরাসের সেনা কর্মকর্তা ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশেনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির ছাত্র। হন্ডুরাসের ২০০৯ এর সামরিক অভ্যুত্থান-এর পর ওবামা প্রশাসন এটা ঠিক করে উঠতে পারেনি যে এটা অভ্যুত্থান নাকি অভ্যুত্থান নয়! স্পষ্ট মার্কিন মদদেই সমস্ত অভ্যুত্থান হয় বলে অভিযোগ।
দক্ষিনপন্থী ন্যাশেনাল পার্টির আমলেই ২০১৩ সালের পর ২০১৮ সালে আবার অস্কার চিনচিলাকে পুনঃনিয়োগ করা হয়। চিলচিলা তার কার্যলালে পরিবেশ আন্দোলন এবং মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে এবং ধনী ব্যবসাদার এবং দূর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে পক্ষপাতীত্ব দেখান বলে অভিযোগ।
ন্যাশনাল কংগ্রেসের সেক্রেটারি এবং শাসক পার্টির সদস্য কার্লোস জেলায়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “ন্যাশনাল পার্টি এমন একজন প্রসিকিউটর নির্বাচন করতে ভয় পায় যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করতে পারেন।”
ন্যাশেনাল পার্টির বা হার্নান্ডেজ মার্কিন ঘনিষ্ঠ হলেও শিওমারা কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসার পর চীনের সাথে বন্ধুত্ব বৃদ্ধি করেছে। এই বছর ২৫ মার্চ হন্ডুরাস তাইওয়ান রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে চীনকে স্বীকৃতি দেয়, এবং চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংবাদ সংস্থা ভয়েস অফ আমেরিকা প্রতিবেদন প্রকাশ, “হন্ডুরাসের সিদ্ধান্ত হল এক সপ্তাহের মধ্যে চীনের দ্বিতীয় পররাষ্ট্র নীতি অভ্যুত্থান” প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি চুক্তির মধ্যস্থতা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্পষ্টতই ইরান-সৌদিশান্তি স্থাপন বা হন্ডুরাস-চীনের সম্পর্ক ভালো চোখে দেখছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এর পর গত ২১ অগাস্ট মধ্য আমেরিকান পার্লামেন্টে ভোটাভুটির মধ্যে দিয়ে স্থায়ী পর্যবেক্ষক হিসেবে রিপাবলিক অফ চায়না বা তাইওয়ানকে অপসারণ করে পিপলস রিপাবলিক অফ চায়নাকে। তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেফ লিউ প্রেসকে বলেছেন, পারলেসেন থেকে তাইপের প্রস্থান “লাতিন আমেরিকায় কর্তৃত্ববাদের বিস্তৃতি প্রদর্শন করে।”
পার্লাসেনের মধ্যে, এল সালভাদর, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, পানামা এবং পূর্বোক্ত হন্ডুরাস এবং নিকারাগুয়ার আনুগত্য পরিবর্তনের পরে শুধুমাত্র গুয়াতেমালা তাইওয়ানের সাথে তার ঐতিহ্যগত মৈত্রী বজায় রাখে।
১৭ই জুলাই চীনের সাথে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন প্রসঙ্গে শিওমারা বলেন “উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক বিনিময় এবং সহযোগিতার ভিত্তি স্বাধীন এবং সার্বভৌম নীতি, না গলানো কখনোই নয়।”
ইতিমধ্যে ২৮ অগাস্ট এই সঙ্ঘাতের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সাংসদ মারিয়া এলভিরা সালাজার বলেছেন “হন্ডুরাসের শিওমারাকে আরো বেশী বেশী করে তার স্বামী জেলায়ার মত মনে হচ্ছে, প্রবল অনুরাগে নিজেকে কাস্ত্র-চাভেসপন্থার সাথে জড়িয়েছে।” প্রসঙ্গত বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দেখা না গেলেও, এই বছর ২ ফেব্রুয়ারী হাইউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভে এলভিরার নেতৃত্বে “ডিনাউন্সিং দ্য হরর অফ স্যোশালিজম” বা “সমাজতন্ত্রের ভয়াবহতা নিন্দা” প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
লাতিন আমেরিকায় শেষ ঘাঁটি কলম্বিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছাড়া হয়েছে। ২০২২ সালে অগাস্টে ক্ষমতায় এসেছেন বাম নেতা গুস্তাভ পেত্র৷ এর পর ঐ বছর ডিসেম্বরেই পেরুতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকায় আবার একটি বন্ধু জোগাড় করেছে বকে অভিযোগ। শিওমারা কিউবা, ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়ার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে লাগাতার সোচ্চার হন, তাদের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার দাবি করেন। শিওমারার কপালে সামরিক অভ্যুত্থান আছে নাকি, বদলাতে থাকা বিশ্ব পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন, সেটাই দেখার।