Close

ফ্রান্স জ্বলছে, এক রাতে ধৃত ৮৭৫, মোতায়েন ৪০,০০০ পুলিশ

বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে ফ্রান্স। একরাতেই গ্রেপ্তার ৮০০র বেশি মানুষ। ফ্রান্স-এ এনকাউন্টারে আফ্রিকান কিশোরের মৃত্যুর জেরে বিক্ষোভ।

Image by kalhh from Pixabay

প্যারিসের শহরতলিতে পুলিশের গুলিতে এক কিশোরের মৃত্যুর পর থেকে জ্বলন্ত পরিস্থিতি দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্স-এ। প্রশাসন সূত্রে খবর আপাতত জরুরি অবস্থা জারি করা না হলেও যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা জরুরি অবস্থাকেও ছাপিয়ে যাবে। জ্বলেছে গাড়ি, বাড়ি, দোকান। আহত হয়েছেন প্রচুর পুলিশ আধিকারিক। রক্তক্ষয়ী হিংসা রুখতে যাবতীয় দিক পর্যালোচনা করে দেখছে ফ্রান্সের প্রশাসন। এমনটাই জানানো হয়েছে ফ্রান্স সরকারের তরফে।



ফ্রান্স-এর ঘটনাটি ঠিক কী ঘটেছে?

গত মঙ্গলবার, ফ্রান্স-এ ১৭ বছর বয়সি এক কিশোরকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। ১৭ বছর বয়সী, নাহেল এম নামে চিহ্নিত ওই কিশোর, মঙ্গলবার সকালে একটি গাড়ি চালাচ্ছিলেন তখন তাকে ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এমনটাই জানিয়েছেন প্রসিকিউটররা। ফ্রান্স-এ একটি সম্পূর্ণ ড্রাইভিং লাইসেন্স ধারণ করার জন্য কিশোরটির বয়স যথেষ্ট ছিল না।

পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে যে একজন অফিসার কিশোরকে লক্ষ্য করে গুলি করেছিল কারণ সে তার দিকে গাড়ি চালাচ্ছিল। তাতেই মৃত্যু হয় ওই কিশোরের। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, গাড়ির চালকের আসনের দিকে দাঁড়িয়ে আছেন দুই পুলিশ অফিসার। প্রাথমিকভাবে কোনও বিপদের কিছু না থাকলেও চালককে লক্ষ্য করে এক অফিসার চালিয়ে দেন। নাহেলকে গুলি করার জন্য ওই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় হত্যার প্রাথমিক অভিযোগ রয়েছে। প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে, প্রসিকিউটর বলেছেন যে, তিনি উপসংহারে পৌঁছেছেন “অস্ত্রের আইনী ব্যবহারের শর্ত পূরণ করা হয়নি।”

এরপর থেকেই দফায় দফায় উত্তেজনা ছড়াতে থাকে ফ্রান্স-এর জনগণের মধ্যে। মন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন জানিয়েছেন, সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে ২৯শে জুন। গোটা দেশ জুড়ে অস্থিরতার দ্বিতীয় দিনে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, নাহেল উত্তর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ছিলেন। এই ঘটনাটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির মধ্যে পুলিশি সহিংসতা এবং পদ্ধতিগত বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন অভিযোগকে মাটি খুঁড়ে তুলে এনেছে৷

প্রাথমিকভাবে প্রায় ২০০০ পুলিশকে বিক্ষোভের এলাকায় মোতায়েন করা হয়। প্যারিসেও দফায় দফায় উত্তেজনা ছড়ায় গত ২৮শে জুন, মাঝরাতে। পুলিশকে লক্ষ্য করে আগুনের গোলা ছোঁড়া হয় বলেও জানা গেছে। ফ্রান্স-এর শহর লিল, টাউলাউস, আমিয়েন্স, ডিজন, এসোনি সহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা হয়েছে। তবে ওই কিশোরকে গুলি করার ঘটনা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে খবর।


হঠাৎ ফ্রান্স-এ এই বিক্ষোভ ছড়ালো কেন?



নাহেল এমের-এর খুনের ঘটনার পরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন ফ্রান্স-এর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। লাগাতার বৈষম্যের কারণে গরিব, ভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে ক্রমশ যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, তা মঙ্গলবারের ঘটনার পর আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভার মতো বেরিয়ে আসতে থাকে। ফ্রান্স-এর বিভিন্ন শহর এবং শহরতলি এলাকায় হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ফরাসি পুলিশের হাতে বেশ কিছু লোক মারা গেছে বা আহত হয়েছে, যা আরও জবাবদিহিতার দাবিকে প্ররোচিত করেছে। মিনেসোটায় পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সও জাতিগত প্রোফাইলিং এবং অন্যান্য অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখেছে।

মঙ্গলবারের হত্যাকাণ্ডটি ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত ফ্রান্স-এ ট্রাফিক স্টপ চলাকালীন তৃতীয় মারাত্মক গুলির ঘটনা। গত বছর এই ধরনের রেকর্ড ১৩টি গুলির ঘটনা ঘটেছে, জাতীয় পুলিশের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন। ২০২১ সালে তিনটি এবং ২০২০ সালে দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, রয়টার্সের একটি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে বেশিরভাগ ঘটনার শিকার ছিল কৃষ্ণাঙ্গ বা আরব বংশোদ্ভূত মানুষ।



বিক্ষোভ কতদূর গড়িয়েছে?


প্যারিসের তুলনামূলক নিম্নবিত্ত এলাকা, মার্সেই, লিয়ঁ, তুলুস, লিলির মতো জায়গায় লাগামছাড়া হিংসা ছড়িয়েছে। পোড়ানো হয়েছে অসংখ্য গাড়ি। লিয়ঁ-তে ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। উত্তর প্যারিসে একটি ডিপোয় ১২টি বাস পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। জাতীয় পুলিশের একজন মুখপাত্রের মতে, পুলিশ এবং অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং রাতের মধ্যে অসংখ্য দাবানল নিভানোর জন্য লড়াই করেছে যা স্কুল, থানা এবং টাউন হল বা অন্যান্য পাবলিক ভবনগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

ন্যাশনাল পলিসি একাধিক শহরে আগুন বা সংঘর্ষের খবর দিয়েছে, দক্ষিণে টুলুস থেকে উত্তরে লিলি পর্যন্ত, যদিও উত্তেজনার নেক্সাস ছিল নান্টেরে এবং প্যারিসের অন্যান্য শহরতলী। মন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন বলেছেন, বৃহস্পতিবার রাতে অস্থিরতায় ২০০ জনেরও বেশি পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। ফায়ার ব্রিগেড এবং ৬,০০০-এরও বেশি পুলিশ অগ্নিকাণ্ড রুখতে অংশ নিয়েছিল, তিনি আরও বলেন, প্রায় ৫০০টি সরকারি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই অস্থিরতা ২০০৫ সালের দাঙ্গার স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে যা ফ্রান্স-কে তিন সপ্তাহের জন্য আন্দোলিত করেছিল এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জ্যাক শিরাককে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য করেছিল। সহিংসতার সেই ঢেউ প্যারিসের শহরতলির ক্লিচি-সুস-বোইসে ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকার সময় বিদ্যুৎ সাবস্টেশনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই যুবকের মৃত্যুর পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দশ বছর পর বিচারে দুই কর্মকর্তা ছাড়া পান।


সরকারের পক্ষ থেকে কী প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে?


শুক্রবার সকালে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সিনিয়র মন্ত্রীদের সাথে একটি সঙ্কট সভা করেছেন যা এই দুই দিনের মধ্যে দ্বিতীয়। ফরাসি সরকার এখন পর্যন্ত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ভাবনা বন্ধ করে দিয়েছে। ডারমানিন বলেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার সূর্যাস্তের আগে সমস্ত পাবলিক বাস এবং ট্রাম পরিষেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করার নির্দেশ জারি করেছে।

তবে ক্রাইসিস মিটিং-এ ঠিক কী কী বিষয় পর্যালোচনা করা হচ্ছে, তা স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি। ফ্রান্স-এর প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আপাতত জরুরি অবস্থা জারি করা হচ্ছে না। যদিও পুলিশের গুলিতে আলজারিয়া এবং মরক্কোর বংশোদ্ভূত এই কিশোরের মৃত্যুর ঘটনার ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পরে ফ্রান্সে যে হিংসা ছড়িয়েছে, তা কার্যত ফ্রান্স সরকারের হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়ি, বাস, গাড়ি। নির্বিচারে অসংখ্য দোকানে লুটপাঠ চলেছে। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। আহত হয়েছেন ২০০-র বেশি পুলিশ আধিকারিক।

বর্তমান পরিস্থিতি


এখন পরিস্থিতি এমনই হয়েছে যে ফ্রান্স-এর একাধিক বড় শহরে গণপরিবহণ ব্যবস্থা সরকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সূত্র উদ্ধৃত করে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়েছে যে প্যারিসে প্রতিদিন রাত ন’টার পর থেকে বাস এবং ট্রাম পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাবে। আবার ফ্রান্স-এর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মার্সেইতে সন্ধ্যা সাতটার পর গণপরিবহণ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রশানের তরফে জানানো হয়েছে, রাতভর ৮৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০০-র বেশি পুলিশ আহত হয়েছেন। ৪০,০০০-র বেশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

Leave a comment
scroll to top