দীপু চন্দ্র দাস কখনো বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চাননি। তাঁর বাবা ও চাচাতো ভাই জোর দিয়ে বলেন, তিনি তাঁর দেশকে ভালোবাসতেন। অথচ তাঁর মৃত্যু এখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৮ই ডিসেম্বর রাতে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় একটি ইসলামপন্থী মব ৩২ বছর বয়সী দীপু দাসকে গণপিটুনিতে হত্যা করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করার। তাঁর পরিবার বলছে, এই অভিযোগ ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট। প্রকৃত কারণ ছিল মজুরি নিয়ে বিরোধ।
বাংলাদেশে দীপু দাসের গণপিটুনি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সেই একই রাতে ঢাকা জ্বলছিল। ইসলামপন্থী জনতা সংবাদপত্র অফিস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালায়। তারা চরমপন্থী ইসলামপন্থী নেতা শরিফ ওসমান হাদীর মৃত্যুর প্রতিবাদ করছিল। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সেই জনতাকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই অস্থির পরিস্থিতিতে দীপু দাসের হত্যাকাণ্ড নতুন করে আগুনে ঘি ঢালে।
শ্রমিকের অভিযোগ মৃত্যুদণ্ডে পরিণত
দীপু দাসের পরিবার ভিন্ন বয়ান দিচ্ছে। তাঁর বাবা রবি চন্দ্র দাস এবং বোন চম্পা দাস বলেন, ধর্মঅবমাননার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। দীপু দাস জামিরদিয়া এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যার্স বিডি লিমিটেড কারখানায় কাজ করতেন। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। কারখানা বেশি উৎপাদন চাইত। কিন্তু মজুরি বাড়াতে অস্বীকার করত। পরিবারের দাবি, এই বিরোধই তাঁর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দীপু দাসের কোনো সহকর্মী তাঁকে নবীজির বিরুদ্ধে কিছু বলতে শোনেননি। পরিবারের অভিযোগ, সাবেক আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ তাঁর হিন্দু পরিচয়কে কাজে লাগিয়েছে। তারা ঘটনা বিকৃত করে জনতাকে উসকে দিয়েছে।
পুলিশ অস্বীকার করেছে যে তারা দীপু দাসকে হত্যাকারীদের হাতে তুলে দিয়েছে। কর্মকর্তারা দাবি করেন, হামলার কয়েক ঘণ্টা পরে তারা খবর পেয়েছেন। পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের যৌথ অভিযানে ২১শে ডিসেম্বরের মধ্যে ১২ জনের বেশি সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ময়মনসিংহে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে। তাদের কর্মীরা ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে এবং সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তবু অনেকের কাছে ন্যায়বিচার এখনো অধরা।
ঢাকা ও নয়াদিল্লি কীভাবে একটি হত্যাকাণ্ডকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে
উভয় সরকারই এখন দীপু দাসের গণপিটুনিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে। ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এতে সুযোগ খুঁজে পেয়েছে। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ—যেখানে বাংলাদেশি হিন্দু অভিবাসীর সংখ্যা বেশি—আগামী বছর নির্বাচনের মুখে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল আসামে ক্ষমতায় আছে। পশ্চিমবঙ্গ দখলের স্বপ্ন দেখছে। এই হত্যাকাণ্ড তাদের হাতে গোলাবারুদ তুলে দিয়েছে।
বিজেপি এবং তার পিতৃসংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) সারা ভারতে ইসলামভীতি ছড়াচ্ছে। তারা বাংলাদেশকে মুসলিম হুমকির প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরছে। দীপু দাসের গণপিটুনির ভিডিও হিন্দুত্ববাদী নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়েছে। জায়নবাদী-ঘনিষ্ঠ অ্যাকাউন্টগুলো বিশ্বব্যাপী এটি প্রচার করছে। এই ফুটেজ ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণার জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে।
ভারত বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু সুরক্ষায় ব্যর্থতার জন্য অভিযুক্ত করেছে। ঢাকায় ভারতীয় মিশনের বাইরে ইসলামপন্থীদের বিক্ষোভের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে। চট্টগ্রামে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রে হামলার উদ্বেগও যুক্ত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, হিন্দুত্ববাদী কর্মীরা নয়াদিল্লির চাণক্যপুরীতে বাংলাদেশ দূতাবাসের নিরাপত্তা ভেঙে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দুই দেশই ভিসা প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে। বাংলাদেশ মঙ্গলবার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে।
দুই দেশের চরমপন্থী শক্তি পরস্পরকে শক্তিশালী করছে
আরএসএস-নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিমবিরোধী সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো গরুর মাংস খাওয়া বা পরিবহনের অভিযোগে মুসলিমদের গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। ২০১৮ সাল থেকে মোদি সরকার গণপিটুনির ঘটনা আলাদাভাবে নথিভুক্ত করা বন্ধ করে দিয়েছে। গবেষণায় বিজেপি ও আরএসএস-এর সঙ্গে মুসলিমবিরোধী সহিংসতার যোগসূত্র পাওয়া গেছে। এই পটভূমিতে ভারতের চরমপন্থীরা বাংলাদেশের দিকে আঙুল তুলে নিজেদের দায় এড়াচ্ছে।
একই সময়ে, বাংলাদেশের ইসলামপন্থী শক্তি দীপু দাসের পক্ষে প্রতিবাদকারী বামপন্থীদের হিন্দুত্ববাদী সমর্থক বলে অভিযুক্ত করছে। সিপিবি ও তার মিত্ররা জবাবদিহিতা দাবি করছে। তারা উভয় পক্ষের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ভারতে চরমপন্থীরা ভারতীয় বামপন্থীদের ইসলামপন্থীদের সঙ্গে যুক্ত করছে। বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা বামপন্থীদের হিন্দু সমর্থক বলে চিহ্নিত করছে। এই ধারা সীমান্তের দুই পারে একইভাবে চলছে।
চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী ও ইসলামপন্থী শক্তি পরস্পরকে আক্রমণ করলেও তাদের একটি সাধারণ লক্ষ্যবস্তু আছে। উভয়েই গণসহিংসতার বিরোধীদের আক্রমণ করে। উভয়েই শ্রমিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোদের কটাক্ষ করে। উভয়েই সংখ্যাগুরুবাদী শাসনের শিকারদের প্রতি সংহতি প্রকাশকারীদের নিন্দা করে।
অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি পরিবার
দীপু দাস রেখে গেছেন স্ত্রী ও কন্যাকে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার মোকামিয়া কান্দা গ্রামে। পরিবার তার উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়েছে। তাদের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাঁর বাবা ও চাচাতো ভাই তাঁদের শোকের কথা বলেন। কিন্তু নয়াদিল্লির প্রচারযন্ত্র ও ঢাকার ইসলামপন্থী শক্তি এই মৃত্যুতে সুবিধা খুঁজে পাচ্ছে।
বাংলাদেশে দীপু দাসের গণপিটুনি এখন একজন মানুষের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বড় কিছু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি এখন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক এজেন্ডার হাতিয়ার। দুই সরকার এই ট্র্যাজেডি থেকে যতটুকু সম্ভব আদায় করে নিচ্ছে। দুই পারের চরমপন্থীরা আরও শক্তিশালী হচ্ছে। ভুক্তভোগী পরিবার আরও দরিদ্র হচ্ছে। আর যারা এই বিভাজন ঘোচাতে পারত—শ্রমিক আন্দোলন, শান্তির পক্ষের মানুষ, সংখ্যাগুরুবাদী সহিংসতা প্রত্যাখ্যানকারীরা—তারা চারদিক থেকে চাপে পড়ছে।
