গত ১৪-১৫ই আগস্টের রাতে আরজি করে হামলাকারীরা নাকি তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী, অভিযোগ করলেন অঞ্চলেরই প্রাক্তন তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) কর্মী। আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য ইস্ট পোস্ট বাংলা কে জানালেন সেখানকার স্থানীয়রা।
অভিযোগ, ১৪-১৫ই আগস্ট মাঝরাতে সাম্প্রতিক আরজি কর হাসপাতালে হওয়া এক চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদে সংগঠিত হওয়া মিছিল ও আন্দোলন থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে এই হামলা করা হয়েছিল সরকারি হাসপাতালটির জরুরী ও তিন তলা স্থিত কান-নাক-গলা (ইএনটি) বিভাগে। বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ও বামপন্থী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই(এম)] নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই এই ঘটনার জন্যে তৃণমূল কংগ্রেস দলটিকে অভিযুক্ত করে আসলেও সেই দলের নেতারা বিজেপি ও বামেদেরই দায়ী করে।
বিজেপি ও বামপন্থী সিপিআই(এম) অভিযোগ করেছে যে মিছিলকারীদের নামে দোষ দেওয়ার জন্যে সরকার পক্ষ এই হামলা করিয়েছে। বিজেপি নেতারা সবার আগে সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করেন যে “বাম আমলে ইংরাজি শিক্ষা তুলে দেওয়ার ফলে” হামলাকারীরা তৃতীয় তল আর থার্ড ফ্লোরের মধ্যে পার্থক্য না করতে পেরে তৃতীয় তলে অবস্থিত ইএনটি রুমটি ভেঙে দেয়।
প্রসঙ্গত এই বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলে (ইংরাজিতে থার্ড ফ্লোরে) রয়েছে সেমিনার রুম যেখানে অপরাধটি সংগঠিত হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বিজেপি অভিযোগ করে যে হামলাকারীরা ওই ঘরটিতে তাণ্ডব করে প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করতে চেয়েছিল।
কিন্তু কারা করলো এই তান্ডব? হামলা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার রাজভবনের বাইরে এই হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনায় বিরোধী বাম বিজেপিকে দায়ি করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ছাত্র-ছাত্রীদের দোষ দিচ্ছি না। বহিরাগত কিছু রাজনৈতিক লোক, যারা বাংলায় অশান্তি তৈরি করতে চায়, বাম ও রাম এক হয়ে গন্ডগোলটা করেছে। সংবাদ সংস্থা আমার কাছে কিছু ভিডিয়ো এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি ও ডিওয়াইএফআই-র পতাকা হাতে ধরা।”
ঘটনার পর বেশ কিছু ব্যাক্তির ছবি প্রকাশ করেছে কলকাতা পুলিশ। কিন্তু কারা তারা? স্থানীয় মানুষেরা ইস্ট পোস্ট বাংলাকে জানিয়েছে, অভিযুক্তেরা পার্শ্ববর্তী এলাকারই তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী। স্থানীয়দের দাবি এদের মধ্যে কেউ জয়পুরিয়া কলেজ এবং মণিন্দ্র কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্য। কেউবা কাশিপুর বেলগাছিয়া যুব তৃণমূল কর্মী।
এক স্থানীয় যুবক, প্রাক্তন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মী জানান, তিনি দেখেছেন অতীন ঘোষ এবং শশী পাঁজা ঘনিষ্ঠ তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা, যারা বাগবাজারে বিভিন্ন ওয়ার্ডে সংগঠন করে, আন্দোলনকারীদের সাথে মিছিলে স্লোগান দিতে দিতে আরজি করের দিকে আসছিলো।
সেই প্রত্যক্ষদর্শী জানান তিনি আরজি করের গেটের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখেন, শান্তনু সেন ঘনিষ্ঠ তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা, যারা বেলগাছিয়ার বাসিন্দা, তাদের হাতে পুলিশের ডান্ডা ছিলো। ক্রমাগত তারা আরজি করের গেটে মারতে থাকে। পুলিশ চুপচাপ দেখছিলো, কেউ কিছু করছে না।
প্রত্যক্ষদর্শী বলেন যে, “মঞ্চ থেকে সিপিআই(এম) নেত্রী দীপ্সীতা ধর বার বার ঘোষণা করতে থাকেন, ‘কেউ আরজি করের গেটের দিকে যাবেন না, কিছু দুষ্কৃতী ভাঙচুর করছে। ওদের প্ররোচনায় পা দেবেন না’। এর ফলে দুষ্কৃতীরা চিহ্নিত হয়ে যায় কারণ, সাধারণ মানুষ গেটের সামনে থেকে সরে আসে। ওরা ওখানে পড়ে থাকে।
স্থানীয় যুবকরা এর পর তাদের ধরে ডান্ডা কেড়ে প্রতিবাদী জমায়েত থেকে বের করে দিতে থাকে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় যুবক জানিয়েছেন, “আমি ওদের চিনতে পারবো। প্রায় প্রত্যেকেই এলাকার পরিচিত তৃণমূল কর্মী”
ঐ যুবক আরো বলেন “পুলিশ সাহায্য চাইলে অবশ্যই আমি সাহায্য করবো”
এমনিতে এখন আর জি করে প্রবেশে নিরাপত্তার কড়াকড়ি বেড়েছে। তার মধ্যে রাত দখলের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত পরিমানে পুলিশ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (র্যাফ) নামানো হয়েছিলো। তার পরেও কীভাবে দুষ্কৃতীরা ঢুকলো? অত পুলিশ এবং র্যাফ থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে দীর্ঘ সময় তান্ডব চালানো হল সেই নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, দুষ্কৃতীরা পুলিশের কাছাকাছিই ছিল, তবুও পুলিশ তাদের না ধরে, আন্দোলনকারীদের দিকেই কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছিল।
স্থানীয় যুবক সায়ন, যিনি নিজের পদবী জানাতে অনিচ্ছুক)বলেন, দুষ্কৃতীদের অনেকেই স্থানীয় এবং মুখ চেনা। চিহ্নিত করা সম্ভব। এরা প্রতিবাদী মিছিলের সাথেই ঢোকে, তার পর আলাদা হয়ে ছিটকে আরজি করের দিকে হন হন করে এগিয়ে যায়। ওদের হাব ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিলো, এরা আবেগে নয় বরং নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি নিয়েই এই কাজ করেছে।”
সায়ন আরো বলেন, দুস্কৃতিরা পুলিশের সামনেই ২০ মিনিটের মত হাসপাতালের ভেতরে তান্ডব চালালো। যদিও ওখানে পর্যাপ্ত র্যাফ ছিলো। পুলিশ হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো, নয়তো বাথরুমে লুকিয়ে থাকলো। তার পর তান্ডবের শেষে হঠাৎ কীসে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনতার দিকে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে লাগলো, আমার ব্যাগে একটি টিয়ার গ্যাসের সেল লেগে ছিটকে যায়।”
আরজি কর স্টুডেন্টস ইউনিটির সংগঠক এবং প্রাক্তন ছাত্র চন্দ্র মৌলি ঝাঁ বলেন, “নাগেরবাজার, উলটো ডাঙা, পাতিপুকুর, বেলগাছিয়া অঞ্চল থেকে প্রায় ২০০০ জন মত কর্মী সমর্থক জড়ো করে শাসক দল, এদের মধ্যে বিশেষ ৫০ জন মত ভাঙাচুরের কাছে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো। পুরো এমারজেন্সি ভেঙে তথনছ করে দিয়েছে।”
যদিও কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েল শুক্রবার আরজি করের ঘটনা নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে শহরজোড়া এই জমায়েত শান্তিপূর্ণ হবে বলেই মনে করেছিল পুলিশ। সিপি জানান, আন্দোলন যে হিংস্র হয়ে উঠবে, তা পুলিশ আন্দাজ করতে পারেনি।
হামলার মুহূর্তের ব্যাখ্যা দিয়ে সিপি বলেন, ‘‘ডিসিপির মাথা ফাটায় আমাদের ফোর্স ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল, সামলে নিতে সময় লাগে। আমাদের উপর হামলা চালানো হয়। একে আমাদের ব্যর্থতা বললে বলুন।’’
‘‘বুধবার রাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার বন্দোবস্ত আমরা করেছিলাম। ডিসি পর্যায়ের আধিকারিক ছিলেন। তা-ও ব্যারিকেড ভাঙা হয়েছে। ডিসিপি আহত হয়েছেন, পুলিশের আরও অনেকে আহত হয়েছেন।’’
এখনো পর্যন্ত যে ধৃত ২৫জনের নাম ঠিকানা প্রকাশ করেছে পুলিশ তারা মূলত হাওড়া, উলটোডাঙা, মানিকতলার বাসিন্দা।
যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবক বলেন, “কলকাতা পুলিশ যে ছবি গুলো প্রকাশ করেছে, তারা সম্ভবত ভেতরে হামলা চালিয়েছে। বাইরে যারা হামলা চালিয়েছে, আমি তাদের চিহ্নিত করতে পারবো।”
সায়ন প্রশ্ন তুলেছে পুলিশ যাদের ছবি প্রকাশ করেছে, তাদের মধ্যে নিরপরাধ আন্দোলনকারীরাও আছে কী না?
সায়ন বলেন “ভিড়ের মধ্যে খুব খারাপ কোয়ালিটির ভিডিওতে দুষ্কৃতী এবং সাধারণ নিরপরাধ প্রতিবাদীদের আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে দুষ্কৃতীরা অনেকেই মুখ চেনা স্থানীয়, নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব।”
আরজি করে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের তদন্তের ভার এখন কেন্দ্রীয় অনুসন্ধান ব্যুরো (সিবিআই) পেলেও, কলকাতা পুলিশের উপর দোষারোপ করা হচ্ছে সঠিক ভাবে তদন্ত না করার জন্যে। এর মধ্যে আরজি করে হামলার ঘটনায় তাদের নিস্পৃহতা, কলকাতা পুলিসের ভূমিকাকে আবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।