রমজান মাস আসতে চলেছে। গত দুই বছর সৌদি আরবে হিন্দু বাড়ির ছেলে হয়ে রমজান এবং ঈদ কাটালাম, যা সত্যিই এক নতুন এবং বিষ্ময়কর অভিজ্ঞতা ছিল আমার জন্য। প্রথম রমজানে আমার ঘরের সামনে যেই মসজিদটা ছিল আমি সেখান থেকেই সারা মাস খাওয়াদাওয়া চালিয়েছি। কিভাবে, তা শুনলে অনেক হিন্দু আমাকে খুব খারাপ চোখে দেখতে পারেন। কমই মসজিদের আর দানের খাবার খেয়ে দিন কাটিয়েছিলাম। এমন নয় যে অন্য খাবার খাওয়ার পয়সা ছিল না, বরং এমন হয়েছিল যে মসজিদ যাওয়ার আগে আমি নিজে টাকা দিয়ে আরো সুস্বাদু খাবার রেস্তোরাঁ থেকে কিনে এনে রেখে দিয়েছিলাম। তারপর বাকি শ্রমিক ভাইদের সাথে মসজিদ গিয়েছিলাম ইফতারির খাবার আনতে।
বেশ আকস্মিকভাবেই হয়েছিল ব্যাপারটা। আমি সেদিন চুপচাপ নিজের ঘরে বসেছিলাম, রমজানের প্রথমদিন। হঠাৎ পাশের ঘরের আনিসরা(নাম পরিবর্তিত) এসে ডাকাডাকি শুরু করলো ওদের সাথে মসজিদ যাওয়ার জন্য। আমি সারাদিন ঘুমিয়েছিলাম তাই এমনিই জল খাওয়া মুখে তোলা হয়নি। না চাইতেই রোজা হয়ে গিয়েছিল আমার সেইদিন! কিন্তু ওরা জানালো খাবার খেয়ে থাকলেও অসুবিধা নেই, আমি যেন শুধু ওদের সাথে যোগ দি। আমি প্রথমে প্রচন্ড বিব্রত বোধ করছিলাম, কারন শুধুমাত্র যে আমি মুসলমান নই তা বলে নয়, আমি কট্টর নাস্তিকও বটে। তাই আমার মতো একজন মানুষকে নিয়ে ওরা বিপদে পরবে না তো?
গিয়ে দেখলাম সমস্ত ধর্মের মানুষ লাইন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ইফতারের সময় হতে, মানে আজানের একটু আগেই সবাইকে এক প্যাকেট করে খাবার বিতরণ শুরু হলো। অনেকে গাড়ি করে এসেও খাবার দিয়ে যায় নিজেদের সাধ্য এবং ইচ্ছা অনুযায়ী। এবার আমার সাথে আমি পাহাড়ি হিন্দু বন্ধুদেরও নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু তারা এক প্যাকেট বুখারি, মানে বিরিয়ানি জাতীয় এক খাবার মসজিদ থেকে নিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিল। তাদের আত্মসম্মানে প্রচন্ড ঘা লেগেছিল নাকি এইভাবে মসজিদ থেকে খাবার নিতে। মন্দিরের ভোগ খাওয়া গেলেও মসজিদের ইমামের হাত থেকে বিরিয়ানি খেতে প্রচন্ড লজ্জা লাগলো আমার কট্টর সনাতনীদের। এবার আমি আর তাদের জোর না করে নিজের বিরিয়ানির দিকে মন দিলাম!
একদিন আবার দেখেছিলাম পাড়ার অনেক বাচ্চারা খেলাধুলা করছিলো মসজিদের সামনে, অনেকে তাদের মধ্যে উত্তর আফ্রিকার জাতির। তাদের কে ডেকে এনে তাদের দিয়ে বিতরণ করানো হচ্ছিল। আমিও সেদিন ওরকমই এক শিশুর হাত থেকে বিরিয়ানি পেয়েছিলাম। তারা আমার ধর্ম জাতি বিচার করেনি, এবং ভিক্ষাদান হিসেবেও দেয়নি। পরম কর্তব্য হিসেবেই তারা এই কাজটা করছে। যারা খাবার নিচ্ছে তারা আমার মতোই লেবারের কাজ করে। বেশিরভাগ মসজিদে আবার ব্যবস্থা হয় বসে খাওয়ার। মসজিদের বাইরে কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয় যার ওপর সবাই সারি অনুযায়ী বসে খাবার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করি। আজানের অপেক্ষা। যতক্ষণ না সেই মসজিদে আজান হবে না ততক্ষণ কেউ জল স্পর্শও করবে না।
সেহরির সময়েও সেরকম আনন্দ হতো। রাতে সবাই মিলে মাংস ভাত, মাছ ভাত রান্না করে এক ঘরে একসাথে কাগজ বিছিয়ে খেতে বসলাম। তাড়াতাড়ি পেট ভরে খেয়ে উঠে যারা রোজা রাখছে তারা দাঁত মেজে শেষ সিগারেটটা তাড়াতাড়ি টান মারবে যাতে সময় মতো সিগারেট আর খৈনিটা খেয়ে ঘুমোনো যায়! ভোরের আজানের আগে এত কাজ শেষ করতে হবে! তখন বুঝেছিলাম এই রমজান মাস নিয়ে এত হৈচৈ আসলে কিসের। সমস্ত ইফতারি আর সেহরি একসাথে করতে হয়, সবাই মিলেমিশে। উপোসটাও যেমন ঘরে অথবা কর্মক্ষেত্রে একসাথে বসে করা হবে তেমন রুটিও একসাথে ভেঙে এক হাঁড়িতে খাওয়া রেওয়াজ। এর মধ্যে যে উত্তরাখণ্ডের লোকগুলো কেন এলো না, তা নিয়ে আর আফসোস করে লাভ নেই।