হাতে নেই কানা কড়ি, আছে শুধু নেই-এর তালিকা।সেই নেই-তালিকা নিয়েই গতকাল অর্থাৎ ২৯শে জানুয়ারি পথে নামলেন দশ হাজার আম্মা। অ্যাসোসিয়েশন ফর মিড-ডে মিল অ্যাসিস্টেন্টস (AMMA)-র কথা বলছি। সাথে ছিল AICCTU, CITU, AIUTUC, পশ্চিমবঙ্গ স্বরোজগারী ও রাঁধুনি ইউনিয়ন, পশ্চিমবঙ্গ রন্ধনকর্মী ফেডারেশনের মতো সংগঠন।
ভোর থাকতে আস্তানা থেকে বেড়িয়ে সকাল সকাল শিয়ালদহ স্টেশন পৌঁছে গিয়েছিলেন একদল নারী শ্রমিক। তারপর কয়েক হাজারের মিছিল নিয়ে যাত্রা শুরু; প্রাথমিক গন্তব্য সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার। সেখানে মিলবে লড়াইয়ের সাথীদের জন্য অপেক্ষারত আরও একদল। দুই দলই হাজার হাজার সংখ্যা বহন করছে। AMMA সহ অন্যান্য সংগঠনের হয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন আয়েশা বিবি, এসেছেন ঝুমা মান্ডি-রা; কিন্তু কেন?
AMMA-র আন্দোলনকারীরা বললেন গত দশ বছরে মাইনে বাড়েনি তাদের। কিন্তু সেই মাইনে কত? একজন সাধারণ কর্মরত মধ্যবিত্তের নূন্যতম মাইনে যদি হয় ১৫০০০ টাকা তবে তার থেকে একটা শূণ্য কমিয়ে দিন। সরকারের বরাদ্দ এই মাথাপিছু ১৫০০টাকা কখনও দুই জন, আবার কখনও দশ জন ভাগ করে নেন। না, দৈনিক নয়, মাসিক। এর পরেও বারো মাস মাইনে পান না তারা। দুই মাস ছুটি বাবদ কাটা যায় প্রাপ্য মাইনে!
হায়রে! তাহলে কি তারা দানছত্র খুলে শ্রম বিকোতে এসেছেন? জানি, তারা চাইলে এ কাজ ছেড়ে অন্যত্র যেতেই পারেন। কিন্তু পেট বড় বালাই। অন্যদিকে মিড-ডে মিল শ্রমিকেরা না বাঁচলে বাঁচবে না সরকারি স্কুল। এখনও পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামে স্রেফ মিড-ডে মিল আছে বলেই স্কুলে পড়তে আসে শিশুরা। আবারও, পেট বড় বালাই!
‘স্বাধীনতা’র ৭৫ বছরপূর্তির উৎসবের ঢক্কানিনাদের নীচে চাপা পড়ে যায় এই বালাইয়ের জ্বালা। আজ এতবছর পরেও এ কলঙ্ক মিটছে কই? তাই আজ AMMA-র এবং অন্যান্য সংগঠনের এই মিছিলের দাবি সব দিক ছুঁয়ে গেল। শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ২৬০০০ করতে হবে; শিক্ষার্থীদের মিড-ডে মিলের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ অর্থ বাড়াতে হবে যাতে পুষ্টি অপূর্ণ না থাকে এবং তার সাথেই মিড-ডে মিলশ্রমিকদের দিতে হবে সরকারি স্বীকৃতি, যাবতীয় সুবিধা ও উৎসবকালীন ভাতা। তবে অন্যতম বড় দাবি ছিল, মিড-ডে মিল প্রকল্পের বেসরকারিকরণ করা যাবে না, একে এনজিওর হাতে তুলে দেওয়া যাবে না।
গত বিধানসভা নির্বাচনের জনপ্রিয়তম স্লোগান ছিল “বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়”। এখন প্রশ্ন হল এই নারী শ্রমিকেরা কি বাংলার মেয়ে নয়? তাদের দাবিকে এবং সমাজে তাদের প্রতিদানকে কি নায্যতা দেওয়া যায় না? অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভা ভোটেও মেয়েদেরকেই পাখির চোখ করেছে তাবৎ রাজনৈতিক দলগুলি, কিন্তু পদ্ধতি সেই ‘ডোল পলিটিক্স’। ‘যোজনা’ আর ‘ ভান্ডার’-এর তলায় কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে না তো শ্রমের নূন্যতম মজুরি, নারীর স্বনির্ভরশীলতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো অত্যন্ত সাধারণ, স্বাভাবিক বিষয়গুলো?
গতবছর, প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে নারী নির্যাতনের গড়ে ৪ শতাংশ বৃদ্ধির সাথেই বাংলায় পণের জন্য হত্যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। এই সমস্যার অন্যতম কারণ নারীর অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা; সব জেনেও অপারগ হয়ে বিষাক্ত পরিস্থিতিতে আটকে থাকা, অতঃপর মৃত্যু। সরকার কী ভাবছে, স্রেফ আইনের হাতকড়া দিয়ে কি এই সমস্যার সমাধান হবে?
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ধীমান বসাকের সাথে কথা বলার সময় তিনি জানান, মিছিলের পর দেখা করেছেন শিক্ষা সচিব। আজ বৈঠক হতে পারে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের সাথে। কিন্তু মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ার বাংলার এই মেয়েদের নিয়ে কী মত তা কোনোভাবেই জানা যায়নি। তিনি কি উদ্বিগ্ন এই খেটে খাওয়া মেয়েদের নিয়ে? তিনি কি তাদের সমস্যা সমাধানে হাত লাগাবেন? নাকি ভাণ্ডারের বহর বাড়বে শুধু? এটাই এখন দেখার বিষয়।