Close

সৌদির চিঠি: শেফেরই নাকি খাবার খেতে মানা! (পর্ব ৩০)

মালিক অ-ব্যবসাদার, ভুগবে শ্রমিক। হোটেলের রন্ধনকর্মীদেরই নাকি হোটেলের পয়সায় খেতে মানা। তারপর ডাকাতের ঘরে লুঠ হচ্ছে কিভাবে? লিখছেন পথিকৃৎ।

মালিক অ-ব্যবসাদার, ভুগবে শ্রমিক। হোটেলের রন্ধনকর্মীদেরই নাকি হোটেলের পয়সায় খেতে মানা। তারপর ডাকাতের ঘরে লুঠ হচ্ছে কিভাবে? লিখছেন পথিকৃৎ।

সৌদির চিঠি পর্ব ২৯

যদি আপনার ঘর থেকে কেউ কিছু জিনিস নিয়ে যায় তাহলে তাকে চুরি বলা হবে আমরা জানি। কিন্তু যদি ডাকাতের ঘর থেকে সমস্ত জনগন মিলে তার জিনিসপত্র তুলে নিয়ে যায়? তাকে কি বলা যেতে পারে? আমাদের দৌলতে ঠিক এরকমই একটা ঘটনা যেন ঘটে চলেছে এই কয়েকদিন ধরে। শুনছি বড়ো বাবুর ওপর নাকি কোম্পানির মালিকদের তরফ থেকে প্রচুর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। কেন মুনাফা আসছে না, কেন এত টাকা ঢালা সত্ত্বেও মনের মতো লাভ আসছে না। এই চাপের মুখে পড়ে সেই ম্যানেজার কর্মীদের খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। নির্দেশ জারি হয়েছে যেন কোনো স্টাফ কোম্পানির খরচায় যেন একটা বিস্কুটও না খায়। এমনকি খাওয়ার জলটাও বন্ধ। ম্যানেজার ব্যাবসায়িক ভাবে অক্ষম, তাই কোপ পড়বে গরীব কর্মীদের ওপর। রেস্টুরেন্টের শেফ হয়ে তার খাওয়া দাওয়া বন্ধ! এই লাইনে কাজ করা কোনো ব্যাক্তি দুঃস্বপ্নেও এমন ভাবতে পারবে না।

তাই এই জন্য স্টাফ যেন এক বিদ্রোহী রুপ ধারন করেছে। এছাড়াও আরো অনেক কারণে মানুষজন ক্ষেপে আছে, কাজের বিষয়বস্তু নিয়ে। তাই নিয়মকানুনের আর কেউ ধার ধারছে না, সবাই ঝামেলা করার সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। আমি এর মাঝখানে অন্যভাবে ফেঁসে ছিলাম এতদিন। আমার এক্সিট পারমিট আসছিল না। তাই রেগে গিয়ে স্টাফ কে বলেছিলাম যেন আমাকে খেতে দেয়! মানে, হোটেলের থেকেই আমি খেতে চেয়েছিলাম বিরক্ত হয়ে। দেখলাম, স্টাফ দুহাত তুলে সমর্থন করলো। নিজেরা খেতে পারছে না ঠিকই কিন্তু ম্যানেজাররা যাওয়ার পর আমি যা চাইছি তাই ভালোবেসে খাওয়াচ্ছে। আমি একরকম রসিকতা করে বলেছিলাম কিন্তু ওরা উৎসাহিত হয়ে পুরো উজাড় করে দিল যেন! তাই এই কদিন প্রায় প্রত্যেকদিন হোটেলেই খেতে যেতাম। রাতে স্টাফের গাড়ি করে হোটেলে গিয়ে পেট ভরে রোজ দারুণ ভুরিভোজ করে আসছি।

এইবার এটার কি গল্প একটু বলি। প্রায় মাসখানেক যখন আমাকে বেশি বসিয়ে রাখছিল তখন ক্ষেপে গিয়ে আমি জানিয়ে দিলাম যে নিজের খরচায় থাকতে পারবো না, কোম্পানি কে জোর করে আমার দায়িত্ব নেওয়াবো। খাওয়াটাও দিতে হবে। তাই একদিন একটু আবদার করেছিলাম সোহেলের কাছে যে আমাদের একটা পাস্তা খেতে চাই। সোহেল খুব খুশি হয়ে আমার জন্য বানিয়ে নিয়ে এলো। তারপর থেকে দেখছি কাউকে একটু বললেই কোনো কিছু অনেকটা করে নিয়ে আসছে আমার জন্য। সেই থেকে ভেবে নিলাম যে এই একদম অনিয়মের চিন্তাধারাতেই এগিয়ে চলার। প্রতিরাতে আসতে শুরু করলাম। স্টাফ আমার জন্য তৈরিই থাকতো, কিছু না কিছু ভালো বানিয়ে খাওয়াতো। কোনোদিন না গেলে আবার সেই নিয়ে অভিমান করতো। তারা আমার পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তারাও সুযোগ নিল যাতে বেশি করে আমাকে খাওয়ানো যায়। হয়তো এতে কারুর কিছুই যায় আসবে না কিন্তু তারা যেন একরকমের বিজয়ী সুখ পাবে, নিয়ম ভাঙার। একসাথে সকলে মিলে যেন এক প্রতীকি নিয়ম ভঙ্গন হচ্ছে। এমনিতেই অন্য কে খাইয়ে বাঙালির এক আলাদা তৃপ্তি লাভ হয়, এখানে কোম্পানির নিয়ম ভেঙে খাইয়ে তো আর ওই আনন্দ।

আগের দিন আবার সায়ন্তনদাদের নিয়ে গিয়েছিলাম, বললাম চলো তোমাদের আজ আমার কাজের জায়গা থেকে খাওয়াবো। তখন দুটো মাত্র খাবারের দাম নিল, বাকি যা যা খাওয়ালাম সেগুলো ওয়েটার থেকে শুরু করে কিচেনের ভেতরে সোহেলরা কেউ বিলে যোগ করলোই না। তার সাথে আরো বেশি করে খেতে দিতে চাইছিলো। একটু আগে একজন ডিউটি বেরোনোর আগে আবার জানিয়ে গেল যেন অবশ্যই আজ রাতে যাই, আমার জন্য নিজে হাতে সে পিজা বানিয়ে রাখবে! কোম্পানির সাথে যতই যুদ্ধ চলুক, এই দুটো বছর আমার বাকি কর্মীদের ভালোবাসার জোরেই টিকে গেলাম।

Leave a comment
scroll to top