ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-এর ২০২২ সালের দেশব্যাপী অপরাধ পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। উদ্বেগজনক ভাবে যাতে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৫১টি করে অভিযোগ দায়ের হচ্ছে শুধুমাত্র মেয়েদের সঙ্গে হওয়া অপরাধের জন্য। যে তথ্যে এনসিআরবি জানিয়েছে ভারতে রাজ্য ভিত্তিক চার্জশিট দাখিল করার হার সার্বিকভাবে ২০২১-এর তুলনায় ১% কমে দাঁড়িয়েছে ৭১.৩%, যা ১৯৯১ সালের হারের সমান। অন্যদিকে অপরাধ নথিভুক্তকরণের হার ২০২১ সালের তুলনায় ৪.৫ শতাংশ কমেছে। পরিমাণগতভাবে ২০২১ সালে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা ছিল ৬০,৯৬,৩১০টি, যা ২০২২ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮,২৪,৯৪৬টি। খুনের অপরাধ নথিভুক্তকরণ ২০২১ সালের তুলনায় ২.৬% কমে দাঁড়িয়েছে ২৮,৫২২টি। তফসিলি জাতি এবং উপজাতিদের সঙ্গে অপরাধের ঘটনা ২০২১ সালের তুলনায় যথাক্রমে ১৩.১% এবং ১৪.৩% বেড়েছে। উপজাতিদের সঙ্গে অপরাধের মধ্যে ১৩.৪% ধর্ষণ এবং ১০.২% শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে এনসিআরবি।
দেশ জুড়ে রাজ্য স্তরে নারীর বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা গত বছরের তুলনায় ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪,৪৫,২৫৬টি। যার মধ্যে অধিকাংশই গার্হস্থ্য হিংসা (৩১.৪%)। ২০২২ সালে অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ২০২টি। যা গত দুই বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। এই তথ্যে উঠে এসেছে ২০২১ সালের তুলনায় দেশ ব্যাপী প্রায় ১০ শতাংশ বর্ধিত ধর্ষণের ঘটনা। ঐ অনুযায়ী দেশে ২০২২ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৮,৫৪৫টি। যার পরিমাণ ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় আড়াই হাজার বেশি। ওই একই তথ্যের ভিত্তিতে (৫,৩৯৯ টি)ধর্ষণের নিরীখে শীর্ষে রয়েছে রাজস্থান। যদিও নথিভুক্ত নারী বিদ্বষি হিংসার হার ২০২১ সালের তুলনায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬.৪ শতাংশ।
এর আগের ২০২১ সালের এন এস আর বি-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের প্রধান শহরগুলির মধ্যে সব থেকে নিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল কলকাতা। ২০২২-এ এসেও কলকাতা সেই তকমা ধরে রেখেছে বলে উক্ত তথ্য মতে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ বা ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধি মাফিক কলকাতায় অপরাধের সংখ্যা কমেছে বলে। ২০২১ সালে যেখানে ১৩,০৬৭টি অপরাধের অভিযোগ নথিবদ্ধ হয়েছিল, সেখানে ২০২২-এ এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১,০৩৮। প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় অপরাধের গড় হার সব থেকে কম কলকাতাতেই (৭৮.২)। যদিও ওই একই তথ্য অনুযায়ী নারী বিরোধী অপরাধের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে চতুর্থ স্থানে। এই বিষয়ে সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ এবং তারপর যথাক্রমে রয়েছে মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের স্থান।
মেট্রোপলিটন শহরের ভিত্তিতে অপরাধ নথিভুক্তকরণের হার কমেছে ১০.৪%, যেখানে চার্জশিট দাখিল করার হার দাঁড়িয়েছে ৫০.৯%। নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা নথিভুক্তকরণের হার মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে প্রায় ১২% বেড়েছে। তবে এবছরেও সার্বিক অপরাধের সাথেই নারীদের সঙ্গে অপরাধের প্রশ্নেও দেশের প্রথম স্থানটা হাতছাড়া করেনি খোদ রাজধানী শহর দিল্লি। এক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২ লক্ষ ৯৮ হাজার ৯৮৮টি। শুধু দিল্লিতেই মহিলাদের উপরে অপরাধের সংখ্যা ১৪,১৫৮টি। যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ১২০৪। গত বছর এই সংখ্যাটা ছিল ২ লক্ষ ৪৫ হাজার ৮৪৪টি। এছাড়াও বছরভর মুম্বইয়ে ৬৯,২৮৯টি এবং বেঙ্গালুরুতে ২৮,৬৬৬টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে বলে এনসিআরবি রিপোর্টে জানিয়েছে।
অন্যদিকে নারীদের উপর সবচেয়ে কম অপরাধের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটোরে। যদিও জনসংখ্যার নিরিখে ছোট শহর আমদাবাদ, পুণে, কোয়েম্বাটোর, সুরাটেও অপরাধের হারে এগিয়ে। উদাহরণ স্বরূপ এই রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতার জনসংখ্যা ১৪.১১ কোটি। সেখানে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ১১,০৩৮টি। অর্থাৎ, প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যায় কলকাতায় অপরাধ হয়েছে ৭৮.২টি। কোয়েম্বাটোরে সব থেকে কম অপরাধের ঘটনা (৪৫৪২টি) নথিবদ্ধ হলেও, ওই শহরের জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ২১ লক্ষ। অর্থাৎ, প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় অপরাধ কলকাতার প্রায় তিন গুণ। তবে চার্জশিট পেশের হারে কলকাতার থেকে এগিয়ে কোচি ও কোঝিকোড়। যার মান প্রতি লক্ষ্য জনসংখ্যার ভিত্তিতে যথাক্রমে ৮৮.১, ৯৫.৯, ৮৯.৪।
সদ্য প্রকাশিত এই রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশেষ এবং স্থানীয় আইনের আওতায় অপরাধের সংখ্যাও কলকাতায় অন্য মেট্রোসিটির তুলনায় কম। রিপোর্টে জানানো হয়েছে ২০২২ সালে কলকাতায় খুন হয়েছেন ৩৪ জন। যা অন্য শহরের তুলনায় কম। দুর্ঘটনার জেরে মৃত্যু হয়েছে ২১৭ জনের। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ১.৫ শতাংশ, তা-ও অন্য শহরগুলির থেকে কম। ভ্রূণ বা শিশুহত্যার মতো অপরাধ কলকাতায় নথিভুক্ত হয়নি। দিল্লি, মুম্বইয়ে এমন ঘটনা যথাক্রমে ৩২টি এবং ১৮টি। ২০২২ সালে কলকাতায় ধর্ষণের ১১টি ঘটনা ঘটেছে বলে নথিতে প্রকাশ। কলকাতায় ধর্ষণের হারও সব থেকে কম। অন্যদিকে পশ্চিম ভারতের দিল্লি (১২০৪), জয়পুর (৪৯৭), ইন্দোরের (১৭৪) মতো শহরে ধর্ষণ ও ধর্ষণের হার অনেক বেশি। এক্ষেত্রে ধর্ষণের হারে দিল্লিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে ইন্দোর ও জয়পুর। অন্যদিকে নারীদের উপরে হামলার ঘটনা চেন্নাই, আহমেদাবাদের তুলনায় কলকাতায় বেশি। আবার দিল্লি, মুম্বইয়ের তুলনায় অনেক কম। অপহরণের মতো অপরাধও দিল্লি, মুম্বইয়ের তুলনায় কলকাতায় নগণ্য বলে রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে।
এনসিআরবি-র রিপোর্টে যদিও এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, এই রিপোর্ট তৈরি হয় মূলত থানায় দায়ের হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে। পুলিশ যদি কোথাও বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ নথিভুক্তই করতে না চায়, তবে অভিযোগের সংখ্যার তারতম্য ঘটতে পারে এবং তাতে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন হবে না। এ প্রসঙ্গে আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ব্যাখ্যা দিয়েছে, কিছু-কিছু রাজ্যে পুলিশ অভিযোগই গ্রহণ করতে চায় না। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই সমস্ত রাজ্যের প্রকৃত অপরাধের পরিসংখ্যান সামনে আসে না। এই কিছু কিছু রাজ্য ঠিক কোনগুলো? এছাড়াও যদি নথিভুক্তকরণের দিক থেকেও দেখা যায় তবে ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলিতেই অপরাধের ঘনবদ্ধতার কারণ কী? একই ভাবে এই রাজ্যগুলিতে ধর্ষণের মতো অপরাধের নথিভুক্তকরণের হার বাড়লেও চড় চড় করে বাড়ছে অপরাধের পরিমাণও। যদি তথ্য বা রিপোর্ট দিয়ে সার্বিক বাচার নাই করার যায় তবে এই রিপোর্ট এক হাত কাজ নিয়ে খাটাখাটনি করে, অর্থব্যায় করে প্রকাশ করারই বা মানে কী? কী বক্তব্য সরকারের? আর সব অপরাধ নথিভুক্ত না হয়েই ভারতের যে চিত্র আন্তর্জাতিক বাজারে উঠে আসছে, তার পর সব অপরাধ নথিভুক্ত হলে সেই ছবিতে কাদার প্রলেপ কতটা মোটা হবে তা ভাবনার বিষয়।